চুল পড়া মানুষের জন্য একটি সাধারণ এবং উদ্বেগজনক সমস্যা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথার চুল পাতলা হয়, আর বাড়তে থাকে চুল কমে যাওয়ার হার। বংশগতিরও প্রভাব আছে। এছাড়া বিভিন্ন রোগবালাই ও অপুষ্টির কারণে নারী-পুরুষ উভয়েরই যেকোনো বয়সে চুল পড়তে পারে। চুল পড়া ঠেকানোর জন্য চুল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে। চলুন জানি-
চুলের জীবনচক্র
মানুষের মাথার প্রতিটি চুলের নিজস্ব আয়ু আছে। আয়ু শেষে প্রতিটি চুল ঝরে যায় এবং তার গোড়ায় বা ফলিকলে নতুন চুল জন্ম নেয়। এই ভাঙাগড়ার খেলা চলতে থাকে। চুলের জীবনচক্রের তিনটি প্রধান পর্যায় রয়েছে:
- অ্যানাজেন স্টেজ: এটি চুলের জন্মানো ও বৃদ্ধির দীর্ঘতম পর্যায়।
- ক্যাটাজেন স্টেজ: এই পর্যায়ে চুলের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায় এবং চুল ফলিকলের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে পড়ে।
- টেলোজেন স্টেজ: এটি চুলের জীবনচক্রের চূড়ান্ত পর্যায়, যেখানে চুল পতিত হয় এবং নতুন চুল জন্ম নেওয়া শুরু হয়।
চুল পড়ার কারণ
বয়স ও বংশগতির প্রভাব
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে চুল পাতলা হয় এবং চুল কমে যাওয়ার হার বাড়তে থাকে। বংশগতিরও একটি প্রভাব আছে, যার কারণে বয়স্ক পুরুষদের মাথায় টাক পড়তে শুরু করে। একে বলা হয় অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেসিয়া। এতে চুলের জীবনচক্রের অ্যানাজেন স্টেজ ছোট হয়ে আসে এবং টেলোজেন স্টেজ দীর্ঘ হয়ে পড়ে। ফলে চুল পাতলা ও ছোট দেখায় এবং কিছু ফলিকল খালি বা শূন্য হয়ে যেতে পারে। নারীদেরও হরমোনজনিত পরিবর্তনের কারণে কিছুটা চুল পড়ার সমস্যা দেখা যায়।
অপুষ্টি ও রোগবালাই
কিছু রোগবালাই এবং অপুষ্টির কারণে চুল পড়ার হার হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। যেমন:
- আমিষস্বল্পতা
- ভিটামিন ডি ও আয়রনের অভাব
- ক্যানসারের কারণে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি
- বিভিন্ন সংক্রমণ (যেমন: টাইফয়েড, যক্ষ্মা, কোভিড-১৯)
- হাইপোথাইরয়েডিজম এবং পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের মতো হরমোনজাতীয় রোগ
- চুলের গোড়ায় খুশকি ও ছত্রাকের সংক্রমণ
এসব ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত কারণটির চিকিৎসা করলে চুল পড়া বন্ধ হতে পারে।
চুল পড়ার চিকিৎসা
ঘাটতি পূরণ ও কার্যকারণ দূরীকরণ
চুল পড়ার চিকিৎসা শুরু করার আগে জানা দরকার ভিটামিন বা খনিজের ঘাটতি আছে কিনা। অনেকেই ক্রাশ ডায়েট করেন, যার ফলে চুল পড়তে শুরু করে। স্বাস্থ্যকর চুলের জন্য সঠিক পুষ্টি দরকার। প্রয়োজন হলে রক্তের আয়রন ও ভিটামিন ডি পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া যেতে পারে। ঘাটতি থাকলে চিকিৎসক সাপ্লিমেন্ট দিয়ে তা পূরণ করার চেষ্টা করেন।
চিকিৎসার ধরন
মিনোক্সিডিল
বয়সের কারণে চুল পড়ার জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ওষুধ হলো মিনোক্সিডিল। মিনোক্সিডিল একটি ঔষধ যা নিশ্চিত ভাবে চুল গজাতে সক্ষম। এটি ক্রিম, ফোম বা স্প্রে আকারে পাওয়া যায়। সঠিক নিয়মে ব্যবহার করলে এটি চুল পড়ার হার কমায় এবং নতুন চুল গজাতেও সাহায্য করে। নারী-পুরুষ সবাই এটি ব্যবহার করতে পারেন। পুরুষের জন্য মিনোক্সিডিল ৫% এবং মিনোক্সিডিল ২% মহিলাদের জন্য।
ফিনেস্টেরাইড
আরেকটি ওষুধ হলো ফিনেস্টেরাইড। এটি পুরুষের টেস্টোস্টেরনের ক্রিয়াকলাপের ওপর কাজ করে এবং ডিএইচটি উৎপাদন বন্ধ করে। এটি কেবল পুরুষরাই ব্যবহার করতে পারেন এবং কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও থাকতে পারে।
যেকোনো ওষুধই ব্যবহার করার আগে, একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করা উচিত এবং ভাল ফল পেতে নির্দিষ্ট মেয়াদে ব্যবহার করতে হবে।
পিআরপি (প্লাটিলেট রিচ প্লাজমা)
পিআরপি একটি সহায়ক পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি চুল পড়ার নির্দিষ্ট বা একমাত্র চিকিৎসা নয়, বরং অন্যান্য চিকিৎসাপদ্ধতিগুলোকে সাহায্য করে।
চুল প্রতিস্থাপন
যখন হেয়ার ফলিকল বা গোড়া নষ্ট হয়ে যায় বা বৃহৎ টাক পড়ে যায়, তখন হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট বা চুল প্রতিস্থাপন করতে হয়। প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে মাথার পেছনের অংশের চুল ব্যবহার করা হয়। এতে ফলিকুলার ইউনিট ট্রান্সপ্লান্ট এবং ফলিকুলার ইউনিট এক্সট্র্যাকশন—এই দুটি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।
চুলের সঠিক পুষ্টি
চুল গজানোর জন্য সঠিক পুষ্টি, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ, সংক্রমণহীনতা, হরমোনের ভারসাম্য তৈরি করা জরুরি।
- পুষ্টি: সঠিক পুষ্টি চুলের বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন, ও মিনারেল থাকতে হবে।
- আমিষ: চুলের গঠনের মূল উপাদান হলো কেরাটিন, যা একটি প্রোটিন। আমিষের ঘাটতি থাকলে চুল পড়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
- ভিটামিন ও মিনারেল: চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে ভিটামিন ডি, ভিটামিন ই, ভিটামিন এ এবং আয়রন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব চুল পড়ার কারণ হতে পারে।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
- সঠিক যত্ন: চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে নিয়মিত শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করুন।
- হেয়ারস্টাইল: চুলের স্টাইলিংয়ে খুব বেশি তাপ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
- মানসিক চাপ কমানো: মানসিক চাপ চুল পড়ার একটি বড় কারণ হতে পারে। তাই মানসিক চাপ কমাতে যোগব্যায়াম বা মেডিটেশনের মতো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করুন।
- প্রাকৃতিক তেল ব্যবহার: নারকেল তেল, আমন্ড তেল এবং ক্যাস্টর তেলের মতো প্রাকৃতিক তেল চুলের বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে।
চুল পড়ার চিকিৎসার ধরন ও কার্যকারিতা
চুল পড়ার চিকিৎসার ধরন এবং কার্যকারিতা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। অনেক সময় চিকিৎসার কার্যকারিতা নির্ভর করে চুল পড়ার মূল কারণের ওপর। তাই শুরুতেই সঠিকভাবে চুল পড়ার কারণ নির্ণয় করা জরুরি।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন
স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা বজায় রাখতে সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত ঘুম এবং নিয়মিত ব্যায়াম অপরিহার্য। এসব উপাদান চুলের বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
- খাদ্যাভ্যাস: সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন যাতে প্রোটিন, ভিটামিন এবং মিনারেলের অভাব না হয়।
- পর্যাপ্ত ঘুম: পর্যাপ্ত ঘুম চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- নিয়মিত ব্যায়াম: নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে দেয়, যা চুলের বৃদ্ধিতে সহায়ক।
বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা নেওয়া
চুল পড়ার চিকিৎসায় বিভিন্ন টোটকা বা কবিরাজি চিকিৎসার পরিবর্তে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা নেওয়া উচিত। এর ফলে চুল পড়ার সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। এজন্য একজন ত্রিকোলোজিস্ট বা হেয়ার লস এবং স্ক্যাল্প এক্সপার্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
শেষকথা
চুল পড়া ঠেকানোর জন্য সঠিক যত্ন, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ব্যক্তির চুল পড়ার কারণ ও পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে, তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। চুলের সঠিক যত্ন এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে চুল পড়া রোধ করা সম্ভব।