প্রতি বছর সারা বিশ্বে অসংখ্য মানুষ অন্ধ হয়ে যান, যার একটি বড় অংশ হার্পিস ভাইরাসের কারণে। হার্পিস ভাইরাস শুধুমাত্র ঠোঁট ও মুখে ফোসকা সৃষ্টি করে না, বরং যৌনাঙ্গেও হার্পিস ছড়িয়ে দিতে পারে। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা, যা একবার শরীরে প্রবেশ করলে আজীবন থেকে যায় এবং এ ভাইরাস পুরোপুরি নির্মূলের উপায় এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। বিশেষত, নবজাতকের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়ালে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে। জ্বরঠোসা সংক্রামক আক্রান্ত হলে হেলাফেলা না করে কিছু সতর্কতা অবলম্বন জরুরী। আজ আমরা জানবো জ্বরঠোসা কি, হওয়ার কারণ ও এ থেকে মুক্তির উপায়।
জ্বরঠোসা কি?
ঠোঁট ও ঠোঁটের চারপাশে সৃষ্ট ক্ষুদ্র ফুসকুড়িকে জ্বরঠোসা বলে। কেউ কেউ এটাকে জ্বসারি নামে চিনেন আবার কেও ঢাকেন জ্বরঠুঁটো। সিলেটে এই রোগ জ্বরন্ডা, জরন্ডা বা জ্বরেন্ডা নামেই বেশি পরিচিত। ইংরেজিতে একে বলে কোল্ড সোর (English: Cold sore)। সাধারণত এই ফুসকুড়িগুলি পুঞ্জাকারে সৃষ্টি হয়। ফুসকুড়িগুলি ফেটে যাওয়ার পর ক্ষত স্থানের উপর শক্ত আবরণ তৈরি হয়ে থাকে। দুই এক সপ্তাহের মধ্যেই জ্বরঠোসা সেরে যায়। জ্বর ঠোসায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শের (যেমন চুম্বন) মাধ্যমে এই রোগ আরেক ব্যক্তিতে ছড়াতে পারে।
জ্বরঠোসা হওয়ার কারণ কি?
জ্বর ঠোসা মূলত হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস (HSV) দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রামক রোগ। এটি বিভিন্নভাবে শরীরে প্রবেশ করতে পারে, যেমন:
- আক্রান্ত ব্যক্তির মুখ বা লালার সংস্পর্শে আসলে।
- আক্রান্ত স্থানে হাত দিয়ে স্পর্শ করার পর অন্য কারও মুখ স্পর্শ করলে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির মুখ যৌনাঙ্গের সংস্পর্শে আসলে।
- হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাসের (এইচ-এস-ভি-১)[English: herpes simplex virus (HSV-1)] এর কারণে ব্যক্তি জ্বরঠোসায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। এই ভাইরাসটি জেনিটাল হার্পিস (genital herpes) সৃষ্টিকারী এইচ-এস-ভি-২ ভাইরাসের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই দুটি ভাইরাস মুখগহ্বর ও যৌনাঙ্গকে আক্রান্ত করে।
- হার্পিস ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষতস্থান থেকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত বাসনপত্র, শেভিং রেজার এবং তোয়ালের মাধ্যমেও এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির ফুসকুড়ি থেকে তরল ক্ষরণের সময় জ্বরঠোসা সবচেয়ে বেশি সংক্রামক অবস্থায় থাকে, তবে আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বকে কোনো ফুসকুড়ি না থাকলেও তার শরীর থেকে জ্বরঠোসার ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে।
- শরীরে ইনফেকশন সৃষ্টির পর এই ভাইরাস ত্বকের স্নায়ু কোষের মধ্যে সুপ্তাবস্থায় থেকে যায়, এবং পরবর্তীতে আবারও আক্রান্ত স্থান বা তার পাশে ইনফেকশন সৃষ্টি করতে পারে।
এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পর সারাজীবন থেকে যায়। সাধারণত এটি নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে, তবে মাঝে মাঝে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে এটি আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম ছাড়াও আরও কিছু কারণেও এই ভাইরাস আবারও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে, যেমনঃ জ্বর, রজঃস্রাব, শারীরিক বা মানসিক চাপ, ক্লান্তি, রোদ লাগা ইত্যাদি।
জ্বরঠোসার লক্ষণ গুলো হল
জ্বর ঠোসা মুখের যেকোনো স্থানে হতে পারে। সাধারণত ফোসকা ওঠার আগে আক্রান্ত স্থানে জ্বালাপোড়া, ঝিম ঝিম বা চুলকানি দেখা যায়। এর পরবর্তী ৬-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে:
- ছোট ছোট ফোসকা ওঠে, যেগুলোতে তরল থাকে
- ত্বকে লাল লাল ফুসকুড়ির (English: skin rash) সৃষ্টি হয়
- ঠোট ফুলে যাওয়া
- ফোসকা ফেটে গিয়ে তার ওপর চলটা পড়ে
১০ দিনের মধ্যে জ্বর ঠোসা সেরে ওঠে, তবে এ সময় এটি অত্যন্ত সংক্রামক থাকে।
জ্বরঠোসায় আক্রান্ত ব্যাক্তিদের মধ্যে সাধারণত নিম্নলিখিত লক্ষনগুলো দেখতে পাওয়া যায়-
কোন কোন বিষয়গুলো জ্বরঠোসার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ?
সমগ্র বিশ্বের প্রায় ৯০% প্রাপ্তবয়স্কের শরীরেই জ্বরঠোসা সৃষ্টিকারী ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এমনকি যাদের শরীরে এর ইনফেকশনের কোনো লক্ষণ পাওয়া যায় না, তাদের শরীরেও এই ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যেসব ব্যক্তির ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল (রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা) তাদের শরীরে এই ভাইরাসজনিত সমস্যা বেশি দেখা দেয়। যে সব রোগ ও চিকিৎসা জ্বরঠোসার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে সেগুলি হল-
- এইচ-আই-ভি/এইডস
- এ্যাকজিমা
- তীব্রভাবে দগ্ধ/পুড়ে যাইয়া।
- ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃৎ কেমোথেরাপি।
জ্বরঠোসায় আক্রান্ত হওয়ার পর কোন পর্যায়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিৎ?
যদি জ্বরঠোসার লক্ষণ সপ্তাহ দশ দিনের মধ্যে প্রশমিত না হয়, তাহলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিৎ। যদি আক্রান্ত স্থানে চুলকানি, ব্যথা, লাল লাল ভাব থেকে যায় বা বৃদ্ধি পায়; যদি জ্বর হয়, বা আক্রান্ত স্থান ফুলে ওঠে তাহলেও চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন। এছাড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে। চোখের কাছে জ্বর ঠোসা হলে। অনেকখানি জায়গা জুড়ে হলে বা ছড়িয়ে পড়লে। খুব বেশি ব্যথা হলে বা খাওয়াদাওয়ায় সমস্যা হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ। নবজাতক, গর্ভবতী নারী ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হাসপাতালের চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে। সঠিক চিকিৎসা জ্বর ঠোসা থেকে সৃষ্ট জটিলতা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
জ্বরঠোসা থেকে মুক্তির উপায় কি?
জ্বরঠোসা সপ্তাহ দশ দিনের মধ্যে সেরে উঠে, তবে এর লক্ষণগুলি দেখা দিলে অ্যান্টিভাইরাল ক্রিম ব্যবহারে তা দমিয়ে রাখা যেতে পারে। জ্বর হলে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন, মুখের ভেতরের জলো বা লালা যেন ঠোটে না লাগে। আর কোন কারনে যদি লালা ঠোটে লেগে যায় সাথেসাথে গরম পানি দিয়ে ঠোট ধোয়ে নিবেন। শরিরে জ্বর থাকা অবস্থায় এবং জ্বর কমার পর ৩-৪ দিন পর্যন্ত গরম পানি দিয়ে গরগরা করে কুলি করবেন। এতে জ্বরঠোসা থেকে মুক্তি পেলে পেতেও পারেন।
জ্বর ঠোসা হলে করণীয়
সতর্কতা
হার্পিস ভাইরাস চোখে সংক্রমিত হলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। আমাদের চোখের সামনে যে স্বচ্ছ একটি আবরণ থাকে, থাকে কর্নিয়া বলা হয়। কর্নিয়ার সমস্যার অন্যতম সাধারণ কারণ হলো জ্বর ঠোসার হার্পিস ভাইরাসের সংক্রমণ। মুখের জ্বর ঠোসা থেকে ভাইরাসটি চোখে গেলে অন্ধত্বের ঝুঁকি থাকে।
জ্বর ঠোসা থেকে অন্ধত্ব রোধে চারটি পরামর্শ মেনে চলুন—
- জ্বর ঠোসায় হাত দেবেন না
- ভুলবশত হাত দিলে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিন
- জ্বর ঠোসা থাকলে চোখে হাত দেবেন না
- চোখে হাত দেওয়ার আগে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন
তবে মনে রাখবেন, চোখে হার্পিস ভাইরাসের সংক্রমণ হলেও সব সময় মানুষ অন্ধ হয় না। অনেকের ক্ষেত্রে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েও সেরে যায়। তবে গুটি কয়েক মানুষের ক্ষেত্রে এটা চোখের জটিল সংক্রমণে রূপ নিতে পারে। তাই সতর্ক থাকাই শ্রেয়।
ঘরোয়া চিকিৎসা
- অ্যান্টিভাইরাল ক্রিম: জ্বর ঠোসা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই অ্যান্টিভাইরাল ক্রিম ব্যবহার করতে পারেন। এটি দ্রুত সেরে ওঠায় সাহায্য করে।
- মধু: কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, কানুকা মধু জ্বর ঠোসার চিকিৎসায় কার্যকর। দিনে পাঁচবার মধু লাগিয়ে দেখতে পারেন।
- ব্যথা কমানো: বরফ, ঠাণ্ডা সেঁক, লিডোকেইন জেল বা মলম, প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন ব্যবহার করতে পারেন।
- পানিশূন্যতা এড়ানো: পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
- ত্বক ফাটা এড়ানো: পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে ত্বক ফাটা থেকে রক্ষা করুন।
- রোদ থেকে সুরক্ষা: সানস্ক্রিন ও সানব্লক লিপ বাম ব্যবহার করুন।
- বারবার জ্বর ঠোসা হওয়া ঠেকানো: রোদ, মানসিক চাপ ও অতিরিক্ত ক্লান্তি এড়িয়ে চলুন।
জ্বরঠোসায় আক্রান্ত স্থানে কি ঔষধ প্রয়োগ করা যেতে পারে?
জ্বর ঠোসার চিকিৎসায় নিচের মলমটি ব্যবহার করতে পারেন:
এসিক্লোভিরঃ জ্বরঠোসায় ব্যবহৃত জনপ্রিয় একটি কার্যকরী ক্রিম বা মলম। এই ক্রিমটি লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে ব্যবহারে ভাল ফল পাওয়া যায়। এটি ব্যবহার করলে জ্বরঠুঁটো স্বাভাবিক সময়ের পূর্বে সেরে যায়। অ্যান্টিভাইরাল ক্রিম এসাইক্লোভির ফার্মেসিতে ভাইরাক্স, ভাইরক্সি, সিমপ্লোভির ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। এ মলমটি সাধারণত দিনে ৫ বার ব্যবহার করতে হয়। ব্যবহারের পূর্বে ঔষধের সাথে থাকা নির্দেশিকা ভালোমতো পড়ে নিবেন। এসিক্লোভির (English: Acyclovir) চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াও ক্রিমটি ব্যবহার করতে পারবেন। তবে যেকোনো ঔষধ ব্যবহারের পূর্বে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।
শেষ কথা
জ্বর ঠোসা একটি সাধারণ রোগ কিন্তু মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করে এর সংক্রমণ ও জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে জ্বর ঠোসার প্রভাব কমানো যায়।