হঠাৎ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা ব্রেন হেমারেজ একটি বিপজ্জনক এবং জীবন-সংহারক পরিস্থিতি যা জরুরি চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন। নিউরো সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. নজরুল হোসেন এই বিষয়ে প্রথম আলো পত্রিকায় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এখানে আমরা বিষয়টি আরও বিশদভাবে বিবেচনা করব, যা পাঠকদের জন্য আরও তথ্যবহুল ও পঠনযোগ্য হবে।
অ্যানিউরিজম কী এবং কেন হয়?
রক্তনালির বাইরের দিকে বুদ্বুদ বা বেলুনের মতো ফুলে ওঠাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় অ্যানিউরিজম বলে। এটি রক্তনালির নির্দিষ্ট কোনো জায়গার অস্বাভাবিকতা বা দুর্বলতার কারণে ঘটে। অ্যানিউরিজম সাধারণত তিন ধরনের হতে পারে:
- মহাধমনির অ্যানিউরিজম: এটি মহাধমনি বা প্রধান রক্তনালিতে ঘটে।
- মস্তিষ্কের রক্তনালির অ্যানিউরিজম: মস্তিষ্কের রক্তনালিতে ঘটে যা মারাত্মক ঝুঁকি বহন করে।
- হৃদ্যন্ত্রের নিলয়ে অ্যানিউরিজম: এটি হৃদ্যন্ত্রের নিলয়ে ঘটে।
এছাড়া শরীরের যেকোনো জায়গার রক্তনালিতেই অ্যানিউরিজম হতে পারে, যেমন কুঁচকি, হাঁটুর পেছনে, বগলের নিচে বা ঘাড়ে। এটি নাটাই আকৃতির বা থলের মতো হতে পারে।
মস্তিষ্কে অ্যানিউরিজমের লক্ষণ
মস্তিষ্কে অ্যানিউরিজম হঠাৎ করেই মহাবিপদ হিসেবে দেখা দেয়। সাধারণত যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলো:
- তীব্র মাথাব্যথা: এটি হঠাৎ করে এবং অত্যন্ত তীব্র হতে পারে।
- বমি বা বমি বমি ভাব: মাথাব্যথার সঙ্গে এই লক্ষণটি থাকতে পারে।
- ঘাড়ব্যথা ও ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া: ঘাড়ে ব্যথা এবং শক্ত হয়ে যাওয়ার অনুভূতি।
- চোখে ঝাপসা দেখা বা দুটো দেখা: দৃষ্টিশক্তিতে সমস্যা হতে পারে।
- চোখ ব্যথা: চোখে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
- খিঁচুনি: হঠাৎ খিঁচুনি হতে পারে।
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া: মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন।
অ্যানিউরিজমের ঝুঁকিপূর্ণ কারণসমূহ
অ্যানিউরিজমের সম্ভাবনা বৃদ্ধির পেছনে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ কারণ রয়েছে:
- বয়স বৃদ্ধি: বয়স্কদের মধ্যে অ্যানিউরিজমের ঝুঁকি বেশি।
- ডায়াবেটিস: এটি রক্তনালির দুর্বলতা বাড়ায়।
- উচ্চ রক্তচাপ: এটি অ্যানিউরিজমের একটি প্রধান কারণ।
- তামাক সেবন ও মদ্যপান: এগুলো অ্যানিউরিজমের ঝুঁকি বাড়ায়।
- স্থূলতা: ওজন বেশি হলে ঝুঁকি বাড়ে।
- উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল: রক্তনালিতে চর্বি জমা হতে পারে।
- মাথায় আঘাত: মাথায় আঘাত পেলে অ্যানিউরিজমের সম্ভাবনা থাকে।
- সংক্রমণ: কিছু সংক্রমণ রক্তনালির দুর্বলতা ঘটাতে পারে।
- বংশগত প্রভাব: পরিবারের কারো অ্যানিউরিজম থাকলে ঝুঁকি বাড়ে।
অ্যানিউরিজমের চিকিৎসা
অ্যানিউরিজম বা রক্তনালির এই ফোলা অংশ খুবই নাজুক এবং সহজেই ফেটে গিয়ে রক্তপাত হতে পারে। বেশিরভাগ রোগীই মস্তিষ্কে রক্তপাত বা ব্রেন হেমারেজ নিয়ে শনাক্ত হন।
প্রাথমিক চিকিৎসা
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।
- রক্তে লবণের ঘাটতি পূরণ: লবণের ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করা।
- কোষ্ঠকাঠিন্য এড়িয়ে চলা: কোষ্ঠকাঠিন্য এড়িয়ে চলা।
শল্যচিকিৎসা
অ্যানিউরিজমের মূল চিকিৎসা হলো শল্যচিকিৎসা। এটি দুইভাবে করা হয়:
- ক্লিপিং: রক্তনালির ফোলা অংশটির মুখে ক্লিপের মতো আটকে দিয়ে রক্তপাত ঠেকানো হয়।
- কয়েলিং: একটি প্যাঁচানো কয়েল অ্যানিউরিজমের ভেতর সেট করে দেওয়া হয়, যা রক্তনালির মাধ্যমে রক্তপাত আটকায়।
এই দুটি পদ্ধতিই উচ্চপ্রযুক্তি সহায়তায় করা হয় এবং বাংলাদেশে এই চিকিৎসা সম্ভব।
অ্যানিউরিজম ঠেকাতে করণীয়
অ্যানিউরিজম প্রতিরোধের জন্য কিছু করণীয় রয়েছে:
- উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি।
- রক্তের চর্বির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ: কোলেস্টেরল কমাতে হবে।
- আদর্শ ওজন বজায় রাখা: ওজন কমিয়ে রাখা এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা।
- বংশগত সতর্কতা: যাঁদের বংশে এ ধরনের রোগ আছে, তাঁদের কম বয়স থেকেই সতর্ক থাকতে হবে।
- তীব্র মাথাব্যথা হলে হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়া: হঠাৎ তীব্র মাথাব্যথা, বমি বা বমি বমি ভাব, খিঁচুনি হলে বা মাথাব্যথার পর অচেতন হয়ে পড়লে দ্রুত হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে।
অ্যানিউরিজমের ভবিষ্যত চিকিৎসা ও গবেষণা
বর্তমানে অ্যানিউরিজমের চিকিৎসায় অনেক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধের উদ্ভাবন হতে পারে। এই ক্ষেত্রে গবেষণা ও উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে অ্যানিউরিজমের পূর্বাভাস পাওয়া এবং দ্রুত চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে।
শেষকথা
অ্যানিউরিজম একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা যা দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন। তাই উপযুক্ত চিকিৎসা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে অ্যানিউরিজম প্রতিরোধ করা সম্ভব। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত ব্যায়াম, এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অ্যানিউরিজম প্রতিরোধে সহায়ক। বর্তমান চিকিৎসা পদ্ধতির পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তি এবং গবেষণা এই রোগের চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটাচ্ছে। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে অনেক জীবন রক্ষা করা সম্ভব।