বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিংবা শহরে, পেটের ব্যথা বা হালকা জ্বর হলেই মা, চাচি কিংবা ওষুধের দোকানের কম্পাউন্ডার আমাদেরকে সরাসরি সিপ্রোসিন বা মেট্রোনিডাজল খেতে বলেন। এভাবে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হলে এর পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা আমরা অনেকেই জানি না। চলুন, এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কী?
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলো এক প্রকার অবস্থা যেখানে ব্যাকটেরিয়া নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া বিভিন্ন মাত্রায় এন্টিবায়োটিকের মাধ্যমে ধ্বংস করা যায়। কিন্তু যখন আমরা সঠিক মাত্রায় বা পর্যাপ্ত সময় ধরে এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করি না, তখন ব্যাকটেরিয়াগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয় না এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে, পরবর্তীতে সেই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে একই এন্টিবায়োটিক কার্যকর হয় না।
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কেন ভয়াবহ?
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে সাধারণ রোগগুলোও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। যেমন, সাধারণ জ্বর বা ইনফেকশন এখন আরও জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠতে পারে। আমরা যখন রোগাক্রান্ত হই, তখন চিকিৎসক আমাদের রক্ত ও অন্যান্য নমুনা পরীক্ষা করে নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া সনাক্ত করেন এবং নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঔষধ প্রদান করেন। কিন্তু কিছু ঔষধ খাওয়ার পর একটু ভালো অনুভব করলে অনেকেই ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দেন। এতে ব্যাকটেরিয়া পুরোপুরি ধ্বংস না হয়ে রেজিস্ট্যান্স হয়ে যায়।
এতে করে একদিকে যেমন সাধারণ রোগও আর নিরাময় হয় না, অন্যদিকে নতুন ধরনের এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন পড়ে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়তো কোনো এন্টিবায়োটিকই কাজ করবে না। নতুন ঔষধ আবিষ্কার না হলে সাধারণ ইনফেকশনও মহামারি রূপ নিতে পারে।
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণ
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সাধারণত নিম্নলিখিত কারণে দেখা দেয়:
- সঠিক পরিমাণে ও সময়মতো এন্টিবায়োটিক গ্রহণ না করা।
- প্রয়োজন ছাড়াই এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা।
- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজের ইচ্ছামতো এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা।
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধের উপায়
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে কিছু সাধারণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রার এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করুন।
- ঠাণ্ডা লাগা বা সর্দিজ্বর সাধারণত ভাইরাসের আক্রমণে হয়ে থাকে। এন্টিবায়োটিক ভাইরাসের উপর কার্যকর নয়, তাই ঠাণ্ডা লাগলে বা সর্দিজ্বর হলেই এন্টিবায়োটিক খাওয়া শুরু করবেন না।
- চিকিৎসককে বলুন যে খুব প্রয়োজন না হলে যেন আপনাকে এন্টিবায়োটিক না দেন।
- ডাক্তার যতদিন না বলে ততোদিন পর্যন্ত এন্টিবায়োটিক গ্রহণ বন্ধ করবেন না।
সঠিক ব্যবহার না করলে পরিণতি কী হতে পারে?
যারা সঠিকভাবে এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করেন না, তারা নিজেদের পাশাপাশি অন্যদেরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলেন। রেজিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়লে তা একসময় মহামারি রূপ নিতে পারে। অনেক সাধারণ রোগ যেমন নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা বা ম্যালেরিয়া আর সহজে নিরাময় করা সম্ভব হবে না।
সচেতনতা বৃদ্ধি
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। চিকিৎসক ও ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি, সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক ও গণমাধ্যমে প্রচার চালিয়ে এই ব্যাপারে সকলকে জানাতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছে। এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার সীমিত রাখা, সঠিকভাবে গ্রহণ করা, এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার না করা। এছাড়া, সংক্রমণ প্রতিরোধে হাত ধোয়ার অভ্যাস করা, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, এবং সময়মতো টিকা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স একটি মহাবিপর্যয়, যা একবার হলে আর উপায় নেই। তাই সময় থাকতে সচেতন ও সাবধান হওয়া জরুরি। এন্টিবায়োটিক গ্রহণের ব্যাপারে নিজের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত না নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক মাত্রা ও যথাযথ কোর্স পূর্ণ করুন। রেজিস্ট্যান্স হওয়ার আগেই সতর্ক হন এবং ঝুঁকিহীন জীবন যাপন করুন।
অতিরিক্ত তথ্য
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স একটি বৈশ্বিক সমস্যা। প্রতিদিন নতুন নতুন রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কৃত হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে গবেষকরা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে, আমাদের সচেতনতা এবং সঠিক ব্যবহারই পারে এই মহামারির প্রতিরোধ করতে।
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। আসুন, আমরা সবাই মিলে এই বিপর্যয় প্রতিরোধে সচেষ্ট হই এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও নিরাপদ পৃথিবী নিশ্চিত করি।