নিউমোনিয়া হলো একটি মারাত্মক ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ যা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের সংক্রমণের কারণে হতে পারে। এই রোগটি বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে বেশি হলেও, শিশু, তরুণ এবং স্বাস্থ্যবান লোকদেরও আক্রান্ত করতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না করলে নিউমোনিয়া মারাত্মক হতে পারে, এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে। চলুন রোগটির কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে বিশদভাবে জানি।
নিউমোনিয়া কি?
নিউমোনিয়া হলো ফুসফুসের প্রদাহজনিত একটি রোগ যা বিভিন্ন জীবাণুর সংক্রমণের ফলে ঘটে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে ফুসফুসের অভ্যন্তরে প্রদাহ সৃষ্টি হয়, যা শ্বাসনালীর ভেতর বাতাসের চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে শরীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন পেতে ব্যর্থ হয় এবং কার্বন ডাই অক্সাইড শরীরে জমা হতে থাকে। এই প্রক্রিয়া মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড এবং কিডনির মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং রোগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে।
নিউমোনিয়া কিভাবে ছড়ায়?
নিউমোনিয়া বায়ুবাহিত অত্যন্ত সংক্রামক একটি রোগ। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫ বছরের কম বয়সী শতকরা ২২ জন শিশু নিউমোনিয়ার কারণে মারা যায়। এই রোগের জীবাণু বিভিন্ন প্রকারে ছড়ায়:
- হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে: নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে জীবাণু বায়ুতে ছড়ায় এবং সেগুলি শ্বাসের মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
- সরাসরি সংস্পর্শে: নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে সরাসরি সংস্পর্শে আসলে অথবা তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র ব্যবহার করলে জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে।
- শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে: কিছু ক্ষেত্রে জীবাণু শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে ছড়িয়ে রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
- রক্তের মাধ্যমে: কিছু জীবাণু রক্তের মাধ্যমে ফুসফুসে সংক্রমিত হতে পারে।
কাদের নিউমোনিয়া বেশি হয়?
নিউমোনিয়া যে কারোরই হতে পারে, তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে এই রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে:
- শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা: ছোট শিশু এবং বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে, তাই তারা বেশি আক্রান্ত হতে পারেন।
- দীর্ঘস্থায়ী রোগীরা: যারা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা ফুসফুসের কোন রোগে ভুগছেন।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে: এইডস বা অন্য কোন রোগের কারণে।
- ক্যান্সার রোগীরা: যারা কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি নিচ্ছেন।
- স্টেরয়েড ঔষধ সেবনকারীরা।
- ধূমপায়ী ও মাদকাসক্তরা।
নিউমোনিয়ার লক্ষণসমূহ
নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলো নানা ধরণের হতে পারে এবং তা রোগীর বয়স, স্বাস্থ্য এবং রোগের তীব্রতার উপর নির্ভর করে। সাধারণত লক্ষণগুলো হলো:
- জ্বর, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট।
- দ্রুত শ্বাস নেয়া।
- অস্থিরতা বা ক্লান্তি।
- খাবারে অরুচি এবং ওজন হ্রাস।
- বমি বা বমি বমি ভাব।
- পেটে ব্যথা।
- শ্বাস বন্ধ হয়ে আসা।
- বুকের নিচের অংশ শ্বাস নেয়ার সময় ভিতরে ঢুকে যাওয়া।
- শ্বাসকষ্টের কারণে খিঁচুনি।
- নিঃশ্বাসের সময় নাক ফুলে ওঠা।
- মুখ ও ঠোঁটের চারপাশ নীল হয়ে যাওয়া।
- কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা এবং কখনো অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
নিউমোনিয়ার চিকিৎসা
নিউমোনিয়া হলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা জরুরি। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরীক্ষা, যেমন বুকের এক্সরে এবং রক্ত, কফ বা শ্লেষ্মা পরীক্ষা করতে হতে পারে। রোগীর পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা নির্ধারণ করা হয়। মারাত্মক নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন। এ সময় রোগীর খাদ্য এবং পানীয় সম্পর্কেও বিশেষ যত্ন নিতে হয়।
শিশুদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে, তাই শিশুর কোন লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
নিউমোনিয়ার চিকিৎসা সাধারণত এন্টিবায়োটিক, এন্টিভাইরাল বা এন্টিফাঙ্গাল ঔষধ দিয়ে করা হয়, রোগীর সংক্রমণের প্রকারভেদে। তাছাড়া শ্বাসকষ্ট হলে অক্সিজেন থেরাপি এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাসের সহায়ক যন্ত্র ব্যবহৃত হতে পারে।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধে করণীয়
নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা চিকিৎসার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললে এই রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব:
- হাত ধোয়ার অভ্যাস: বাড়ির সবাইকে দিনে কয়েকবার সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত ধোয়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে।
- গর্ভকালীন যত্ন: অপরিণত বা স্বল্প ওজনের শিশুরা পরবর্তীতে সহজেই রোগে আক্রান্ত হতে পারে, তাই গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের পুষ্টি নিশ্চিত করা জরুরি।
- শিশুর পুষ্টি: শিশুর প্রথম ৬ মাস শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত। ৬ মাসের পর মায়ের দুধের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে।
- টিকাদান: শিশুদের সব টিকা সময়মতো দিতে হবে।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: শিশুর থাকার জায়গা এবং বাড়ির পরিবেশ পরিষ্কার রাখতে হবে।
- আলো ও বাতাস: বাড়িতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
- ধূমপান থেকে দূরে: শিশুকে সিগারেট বা চুলার ধোঁয়া থেকে দূরে রাখতে হবে।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্য: বয়স্কদের পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, ধূমপান ত্যাগ করতে হবে।
- সচেতনতা: হাঁচি বা কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখা এবং ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা।
নিউমোনিয়া সম্পর্কিত কিছু পরিসংখ্যান
নিউমোনিয়া বিশ্বব্যাপী একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর ৫ বছর বয়সের নিচে প্রায় ৮ লাখ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রতিবছর প্রায় ৭০ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও সচেতনতার মাধ্যমে এই মৃত্যুর সংখ্যা কমানো সম্ভব।
সমাপ্তি
নিউমোনিয়া একটি মারাত্মক রোগ, তবে সঠিক সচেতনতা, সময়মতো চিকিৎসা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই রোগটির সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। পরিবারের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্কদের যত্ন নেওয়া ও তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব।