পাইলস, যা হেমোরয়েড নামেও পরিচিত, আমাদের দেশে একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। এটি মলদ্বারের শিরা ফুলে ওঠার কারণে মল ত্যাগের সময় প্রদাহ ও রক্তপাতের সৃষ্টি করে। কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে এই সমস্যা আরও বেড়ে যায়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস মেনে চললে এই সমস্যা প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্ভব।
পাইলসের কারণ
পাইলস হওয়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলো হলো:
- দীর্ঘদিন কোষ্ঠকাঠিন্য: কোষ্ঠকাঠিন্য হলে মল শক্ত হয়ে যায় এবং তা বের করতে গেলে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করতে হয়, যা মলদ্বারের শিরা ফুলে ওঠার কারণ হতে পারে।
- আইবিএস (ইরিটেবল বাউল সিন্ড্রোম): আইবিএস থাকার কারণে নিয়মিত ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে, যা পাইলসের কারণ হতে পারে।
- দীর্ঘদিন ডায়রিয়া: দীর্ঘদিন ডায়রিয়া থাকলে মলদ্বারের শিরাগুলোর উপর চাপ পড়ে এবং শিরা ফুলে ওঠে।
- মল চেপে রাখা: দীর্ঘক্ষণ মল চেপে রাখলে শিরাগুলোর উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং পাইলস হতে পারে।
- খাদ্য আঁশের অভাব: প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত খাদ্য আঁশ না থাকলে মল শক্ত হয়ে যায় এবং তা বের করতে গেলে শিরাগুলোর উপর চাপ পড়ে।
- অতিরিক্ত প্রোটিন ও ফ্যাট জাতীয় খাবার: অতিরিক্ত প্রোটিন ও ফ্যাট জাতীয় খাবার গ্রহণ করলে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
- কায়িক শ্রম কম করা: নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম না করলে হজম প্রক্রিয়া সঠিকভাবে হয় না এবং কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
- ওজন বৃদ্ধি: অতিরিক্ত ওজন মলদ্বারের শিরাগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করে।
- গর্ভাবস্থা: অনেক মহিলাদের গর্ভাবস্থায় পাইলসের সমস্যা দেখা দেয়।
পাইলস প্রতিরোধের উপযুক্ত খাদ্য
পাইলস প্রতিরোধে খাদ্যাভ্যাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য আঁশ দুই ধরনের হয়: দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয়। দ্রবণীয় আঁশ পানি শোষণ করে জেল জাতীয় মণ্ড তৈরি করে এবং হজম প্রক্রিয়া স্লথ করে দেয়, ফলে মল নরম হয়। অন্যদিকে, অদ্রবণীয় আঁশ হজম না হয়ে গোটা অবস্থায় মলের সাথে বের হয়ে যায় এবং মল নরম রাখতে সহায়তা করে।
খাদ্যাভ্যাসে যুক্ত করা উচিৎ এমন কিছু খাদ্য:
- সবুজ শাকসবজি: শাকসবজিতে প্রচুর আঁশ থাকে যা মল নরম করতে সহায়তা করে।
- মৌসুমি ফলমূল: মৌসুমি ফলমূলে প্রাকৃতিক চিনি ও আঁশ থাকে যা হজম প্রক্রিয়া সঠিক রাখতে সহায়তা করে।
- লাল আটার রুটি: লাল আটাতে অনেক আঁশ থাকে যা কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে।
- ঢেঁকি ছাটা চাল: এই চালে প্রচুর আঁশ থাকে যা হজমে সহায়তা করে।
- সাবু দানা ও বার্লি: এগুলো হজম প্রক্রিয়া ঠিক রাখতে সহায়ক।
বয়স অনুযায়ী খাদ্য আঁশের চাহিদা
- ২-৫ বছর: ১৫ গ্রাম
- ৫-১১ বছর: ২০ গ্রাম
- ১২-১৬ বছর: ২৫ গ্রাম
- ১৭ এবং তদূর্ধ্ব: ৩০ গ্রাম
প্রতিকার
পাইলসের সমস্যা দেখা দিলে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের পাশাপাশি কিছু নির্দিষ্ট খাবার এড়িয়ে চলা উচিৎ।
এড়িয়ে চলা উচিৎ এমন কিছু খাবার:
- চা, কফি ও ক্যাফেইন: এগুলো কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়াতে পারে, তাই এড়িয়ে চলা ভালো।
- অতিরিক্ত তেল মশলা জাতীয় খাবার: এগুলো হজমে সমস্যা সৃষ্টি করে এবং মল শক্ত করতে পারে।
- রেড মিট: গরুর মাংস বা অন্য কোন রেড মিট কম পরিমাণে গ্রহণ করা উচিৎ।
- প্রক্রিয়াজাত দানা শস্য: এই ধরনের খাবারে ফাইবার কম থাকে যা কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়াতে পারে।
- দুগ্ধজাত খাবার: দুধ, চিজ ও অন্য দুগ্ধজাত খাবার কমিয়ে দেওয়া উচিৎ কারণ এগুলো মল কঠিন করতে পারে।
- অতিরিক্ত অদ্রবণীয় আঁশ জাতীয় শাক: লাউশাক, কুমড়া শাক এড়ানো উচিৎ কারণ এগুলো মল শক্ত করতে পারে।
- প্রিজারভেটিভ সমৃদ্ধ খাবার: বাইরের প্রিজারভেটিভ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ বর্জন করা উচিৎ।
- ধূমপান ও মদ্যপান: ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করা উচিৎ কারণ এগুলো হজম প্রক্রিয়া ব্যাহত করে।
সচেতনতা ও নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম
পাইলস প্রতিরোধ ও প্রতিকারে খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি সচেতনতা ও নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম, পর্যাপ্ত পানি পান, এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চললে পাইলসের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
শারীরিক পরিশ্রমের উপকারিতা
- হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে: নিয়মিত ব্যায়াম হজম প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সহায়তা করে।
- রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়: শারীরিক পরিশ্রম রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে দেয়, যা পাইলস প্রতিরোধে সহায়ক।
- ওজন কমায়: নিয়মিত ব্যায়াম ওজন কমাতে সাহায্য করে, যা পাইলস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
চিকিৎসা
পাইলসের সমস্যা তীব্র হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করা উচিৎ। বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে যা পাইলসের উপসর্গ হ্রাস করতে সহায়তা করে।
চিকিৎসা পদ্ধতি:
- স্থানীয় ওষুধ: মলম বা জেল যা সরাসরি প্রয়োগ করা যায়।
- মলদ্বারে ইলাস্টিক ব্যান্ড বেঁধে রাখা: ছোট ব্যান্ড দিয়ে শিরাগুলোকে সংকুচিত করা হয়।
- স্ক্লেরোথেরাপি: শিরাগুলোকে সংকুচিত করতে রাসায়নিক ইনজেকশন দেওয়া হয়।
- সার্জারি: গুরুতর অবস্থায় সার্জারি করা হয়।
সচেতনতা ও পরামর্শ
পাইলস প্রতিরোধে কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চলা উচিৎ:
- বেশি পরিমাণে পানি পান করুন: প্রতিদিন কমপক্ষে ৮ গ্লাস পানি পান করুন।
- খাদ্য তালিকায় আঁশ যুক্ত করুন: প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় শাকসবজি ও ফলমূল অন্তর্ভুক্ত করুন।
- সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলুন: অতিরিক্ত তেল, মশলা ও রেড মিট এড়িয়ে চলুন।
- ধূমপান ও মদ্যপান এড়িয়ে চলুন: ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করুন।
পাইলস প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সচেতনতা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত পানি পান এবং শারীরিক পরিশ্রমের সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। এসব অভ্যাস মেনে চললে সহজেই পাইলস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।