গলা ব্যথার বিভিন্ন উপসর্গ ও করণীয়

গলা ব্যথা বা ফ্যারিঞ্জাইটিস (Pharyngitis) একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা হলেও এটি অনেক ক্ষেত্রে জটিল রোগের পূর্ব লক্ষণ হতে পারে। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ, ঋতু পরিবর্তন, বহুক্ষণ কথা বলা ইত্যাদি নানা কারণে গলা ব্যথা দেখা দিতে পারে। আসুন, গলা ব্যথার বিভিন্ন লক্ষণ, উপসর্গ ও করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।

গলা ব্যথা কি?

গলা ব্যথা হল একটি শারীরিক সমস্যা যা প্রধানত ফ্যারিঞ্জিয়াল অঞ্চলের প্রদাহের কারণে ঘটে। এর প্রধান কারণ ঠান্ডা ও ফ্লু (ইনফ্লুয়েঞ্জা) এর জীবাণুর সংক্রমণ। অনেক সময় গলা ব্যথার জন্য গলায় শুষ্ক চুলকানি হওয়া সহ ঢোক গিলতে বা খাবার গিলতেও সমস্যা হতে পারে।

গলা ব্যথার কারণসমূহ

গলা ব্যথার জন্য অনেকগুলো কারণ দায়ী। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হল:

  • ভাইরাসজনিত অসুস্থতা: ঠান্ডা, ফ্লু, মনোনিউক্লিওসিস (Mononucleosis) ইত্যাদি।
  • ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ: টনসিলাইটিস, ডিপথেরিয়া ইত্যাদি।
  • এলার্জি: ধূলা, পরাগ রেণু, পশুর লোম ইত্যাদির কারণে।
  • শুষ্ক আবহাওয়া: বিশেষ করে শীতকালে ঘরের তাপমাত্রা বেশি গরম হলে।
  • ধূমপান ও মদ্যপান: সরাসরি ধূমপান করা বা পরোক্ষভাবে ধূমপানের সংস্পর্শে আসা।
  • অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার: মসলা গলার মিউকাস মেমব্রেনকে প্রভাবিত করে।
  • চাপ ও স্ট্রেস: অতিরিক্ত কথা বলা বা গলার মাংসপেশীতে চাপ লাগা।
  • এইচআইভি সংক্রমণ: ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে যাওয়ার ফলে।

গলা ব্যথার লক্ষণসমূহ

গলা ব্যথা হলে প্রধানত নিম্নলিখিত লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দিতে পারে:

  • গলায় খসখসে ভাব: চুলকানো ও গলা ফোলা।
  • শ্বাস নেওয়ার সময় ব্যথা: ঢোক গিলা বা কথা বলার সময় ব্যথা।
  • ঠান্ডার সাথে অন্যান্য উপসর্গ: শরীরে ব্যথা, সর্দি, কাশি, হাঁচি ও জ্বর।

গলা ব্যথার গুরুতর উপসর্গ

গলা ব্যথা যদি মারাত্মক আকার ধারণ করে, তাহলে টনসিল ফুলে যাওয়া সহ নিম্নলিখিত উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে:

  • ঢোক গিলতে বা খাবার খেতে অসুবিধা: গলার প্রদাহের কারণে।
  • বার বার গলা ব্যথা: যা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠতে পারে।
  • বমি হওয়া: প্রায়ই শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায়।
  • ফুসকুড়ি: শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ফুসকুড়ি দেখা দেওয়া।
  • অতিরিক্ত মাথা ব্যথা: গলা ব্যথার সাথে।
  • টনসিল ফুলে লালচে হওয়া: কখনো কখনো টনসিলে পুঁজও হতে পারে।
  • উচ্চ তাপমাত্রা: শিশুদের ক্ষেত্রে ১০১ ফারেনহাইট এবং বড়দের ক্ষেত্রে ১০৩ ফারেনহাইট পর্যন্ত জ্বর।

কাদের গলায় ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি বেশি?

নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের গলায় ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে:

  • শিশু ও কিশোর-কিশোরী: যারা ধুলা বালির সংস্পর্শে বেশি আসে।
  • ধূমপানকারী বা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার: যারা ধূমপায়ী ব্যক্তির কাছে থাকে।
  • এলার্জি সমস্যা রয়েছে এমন ব্যক্তিরা: ধূলা-বালি থেকে এলার্জির সমস্যা।
  • জ্বালানী ও রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিরা
  • দীর্ঘ সময় সাইনাসের সমস্যায় ভুগছেন
  • জনাকীর্ণ স্থানে থাকা ব্যক্তিরা: যেমন- শ্রেণীকক্ষ, অফিস ইত্যাদি।
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এমন ব্যক্তিরা

যেসব জীবনযাপনের মাধ্যমে গলা ব্যথা প্রতিরোধ করা সম্ভব

নিম্নোক্ত নিয়ম কানুন মেনে চলার মাধ্যমে খুব সহজেই আমরা গলা ব্যথার সমস্যা থেকে দূরে থাকতে পারি:

  1. হাত ধোয়া: যতবার সম্ভব সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
  2. ব্যক্তিগত সামগ্রী শেয়ার না করা: অন্যের ব্যাবহার করা খাবার ও জিনিসপত্র শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
  3. অন্যের ব্যবহৃত টেলিফোন বা মোবাইল ব্যবহার থেকে বিরত থাকা
  4. পানির গ্লাস শেয়ার না করা: একই পানির জগ বা গ্লাস মুখ দিয়ে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
  5. পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা: নিয়মিত টেলিফোন, টিভির রিমোট ও কম্পিউটার কী-বোর্ড পরিষ্কার করতে হবে।
  6. অসুস্থ ব্যক্তির থেকে দূরে থাকা: অসুস্থ ব্যক্তি থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে।
  7. বাড়ির আবহাওয়া আদ্র রাখা: বাড়ির আবহাওয়া শুষ্ক থাকলে তা আদ্র রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
  8. হাঁচি বা কাশি দেওয়ার সময় পরিষ্কার রুমাল ব্যবহার: নিয়মিত তা পরিষ্কার করে নিতে হবে।
  9. ধূমপান ও পরোক্ষ ধূমপান থেকে দূরে থাকা
  10. প্রচুর তরল খাবার খাওয়া: গরম চা, পানি ও ফলের রস।
  11. গার্গল করা: ঠান্ডাজনিত সমস্যা হলে এক গ্লাস গরম পানিতে আধা চা চামচ লবণ মিশিয়ে গার্গল করা।
  12. মধু ও লেবুর মিশ্রণ পান করা: এক গ্লাস গরম পানিতে মধু এবং লেবু মিশিয়ে তা ঠান্ডা করে পান করা।
  13. কথা কম বলা: যতটুকু সম্ভব কথা কম বলার চেষ্টা করতে হবে।
  14. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া: সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া।

গলা ব্যথার চিকিৎসা

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গলা ব্যথা সাধারণত এক সপ্তাহ বা কিছুদিন পর এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। তবে যদি এর প্রকোপ বেশি হয়, তাহলে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। যেমন গলা পরীক্ষা (throat culture) ও অন্যান্য শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। রোগের ধরণ জেনে ডাক্তারের পরামর্শ ও নির্দেশ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করা উচিত।

ঘরোয়া চিকিৎসা
  1. লবণ পানি দিয়ে গার্গল: এক গ্লাস গরম পানিতে আধা চা চামচ লবণ মিশিয়ে দিনে ৩-৪ বার গার্গল করলে গলা ব্যথা কমতে পারে।
  2. মধু ও লেবুর মিশ্রণ: এক গ্লাস গরম পানিতে মধু এবং লেবু মিশিয়ে দিনে ২-৩ বার পান করা।
  3. তুলসি পাতা: তুলসি পাতা ফুটিয়ে তার পানি পান করা গলা ব্যথা কমাতে সহায়ক।
  4. আদা চা: আদা ফুটিয়ে তার চা বানিয়ে পান করলে গলা ব্যথা কমাতে পারে।
  5. মুলেঠি (লিকোরিস) রুট চিবানো: প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবে মুলেঠি গলা ব্যথা কমাতে কার্যকরী।
  6. হালকা গরম পানি পান: গলা শুষ্কতা কমাতে ও ব্যথা কমাতে সহায়ক।
ওষুধের চিকিৎসা

গলা ব্যথা যদি মারাত্মক হয় বা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করা উচিত। সাধারণত ব্যবহৃত ওষুধগুলো হল:

  1. পেইন রিলিভার: যেমন আইবুপ্রোফেন বা প্যারাসিটামল।
  2. অ্যান্টিহিস্টামিন: যদি গলা ব্যথা এলার্জির কারণে হয় তবে অ্যান্টিহিস্টামিন সাহায্য করতে পারে।
  3. অ্যান্টিবায়োটিক: যদি গলা ব্যথা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে হয় তবে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দিতে পারেন।
চিকিৎসা সংক্রান্ত নির্দেশনা
  1. প্রচুর পানি পান: দেহ হাইড্রেটেড রাখতে প্রচুর পানি পান করা জরুরি।
  2. গলার বিশ্রাম: যতটা সম্ভব কম কথা বলা ও গলার বিশ্রাম দেওয়া।
  3. সুষম খাদ্য গ্রহণ: পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
  4. পর্যাপ্ত ঘুম: পর্যাপ্ত ও নিয়মিত ঘুমিয়ে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো।

গলা ব্যথার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

গলা ব্যথা প্রতিরোধে নিচের ব্যবস্থা গুলো নিতে পারেন:

  1. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
  2. পর্যাপ্ত বিশ্রাম: দেহের সার্বিক সুস্থতার জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া।
  3. ধূমপান ত্যাগ: ধূমপান করা থেকে বিরত থাকা এবং ধূমপায়ীদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।
  4. স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা: হাত ধোয়া, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা।
  5. জনাকীর্ণ স্থান এড়িয়ে চলা: বেশি জনাকীর্ণ স্থান এড়িয়ে চলা ও সঠিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ।
  6. হাঁচি-কাশির সময় সতর্কতা: হাঁচি বা কাশি দেওয়ার সময় টিস্যু বা রুমাল ব্যবহার করা।

গলা ব্যথার প্রাথমিক সতর্ক সংকেত

গলা ব্যথা কখনো কখনো জটিল রোগের পূর্ব লক্ষণ হতে পারে। কিছু প্রাথমিক সতর্ক সংকেত নিম্নরূপ:

  1. গলা ব্যথার সাথে তীব্র মাথা ব্যথা: মেনিনজাইটিসের লক্ষণ হতে পারে।
  2. গলা ব্যথার সাথে ফুসকুড়ি: স্কারলেট ফিভারের লক্ষণ হতে পারে।
  3. গলা ব্যথার সাথে শ্বাসকষ্ট: ডিফথেরিয়া বা টনসিলাইটিসের লক্ষণ হতে পারে।
  4. দীর্ঘস্থায়ী গলা ব্যথা: গলার ক্যান্সার বা এইচআইভি সংক্রমণের পূর্ব লক্ষণ হতে পারে।

গলা ব্যথা হলে কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?

গলা ব্যথা হলে নিচের পরিস্থিতিতে অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত:

  1. গলা ব্যথা এক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হলে
  2. গলার ভিতরে পুঁজ দেখা দিলে
  3. শ্বাস নিতে কষ্ট হলে
  4. গলার প্রদাহ এতটাই বেশি যে খাবার বা পানি গিলতে সমস্যা হয়
  5. উচ্চ জ্বর: শিশুদের ক্ষেত্রে ১০১ ফারেনহাইট এবং বড়দের ক্ষেত্রে ১০৩ ফারেনহাইট পর্যন্ত জ্বর হলে।
  6. গলা ব্যথার সাথে তীব্র মাথা ব্যথা বা ফুসকুড়ি দেখা দিলে

শেষকথা

গলা ব্যথা একটি সাধারণ শারীরিক সমস্যা হলেও কখনো কখনো এটি জটিল রোগের পূর্ব লক্ষণ হতে পারে। তাই গলা ব্যথা হলে প্রাথমিক সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। সঠিক জীবনযাপন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। গলা ব্যথা যদি মারাত্মক আকার ধারণ করে, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করলে গলা ব্যথা দ্রুত নিরাময় সম্ভব এবং জটিলতার ঝুঁকি কমানো যায়।

Leave a Comment