মুখ ও জিহ্বা শুকিয়ে যাওয়ার কারণ এবং এর সমাধান

মুখ ও জিহ্বা শুকিয়ে যাওয়া বা মুখের শুষ্কতা, যা জেরোস্টোমিয়া (xerostomia) নামে পরিচিত, একটি অস্বস্তিকর অবস্থা যা অনেক কারণেই হতে পারে। মুখে পর্যাপ্ত লালা না থাকলে তা ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় এবং দেহে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া মুখে যথেষ্ট লালা না থাকলে শুষ্কতা ও অস্বস্তি তৈরি হয়। এই নিবন্ধে মুখের শুষ্কতার কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

মুখের শুষ্কতা বা মুখ ও জিহ্বা শুকিয়ে যাওয়ার বিভিন্ন কারণসমূহ

১. নির্দিষ্ট ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

বিভিন্ন ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে মুখের শুষ্কতা হতে পারে। বিষণ্নতা, উদ্বেগ, ব্যথা, অ্যালার্জি, এবং ঠান্ডার ঔষধ যেমন অ্যান্টিহিস্টামিন, স্থূলতা, ব্রণ, মৃগী, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়রিয়া, মানসিক অসুখ, হাঁপানি এবং পারকিনসন্স রোগের ঔষধগুলি মুখ ও জিহ্বা শুষ্ক করে দিতে পারে। মাংশপেশী শিথিলকারী ও ঘুমের ঔষধ অতিরিক্ত গ্রহণ করলেও এ সমস্যা হতে পারে।

২. চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

ক্যান্সারের চিকিৎসা যেমন রেডিয়েশন থেরাপি ও কেমোথেরাপি লালা গ্রন্থিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এছাড়া মাথা ও ঘাড়ে সার্জারি জনিত কারণে লালা গ্রন্থির অপসারণ হলে মুখের শুষ্কতা বৃদ্ধি পায়।

৩. নার্ভ বা স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্থ হলে

আঘাত বা সার্জারির ফলে মাথা ও ঘাড়ের নার্ভ ক্ষতিগ্রস্থ হলে লালা উৎপাদন কমে যায়। এর ফলে মুখ ও জিহ্বা শুষ্ক হয়।

৪. মারাত্মক ডিহাইড্রেশন

জ্বর, অতিরিক্ত ঘাম, বমি, ডায়রিয়া, বা অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। ডিহাইড্রেশন হলে লালা উৎপাদন কমে যায় এবং মুখ শুষ্ক হয়।

৫. অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন

ধূমপান বা তামাক সেবন মুখের শুষ্কতা বাড়িয়ে দেয়। মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়া লালা কমিয়ে দেয় এবং মুখ শুষ্ক করে।

মুখের শুষ্কতার লক্ষণসমূহ

মুখের শুষ্কতা বিভিন্ন উপসর্গের সৃষ্টি করতে পারে। নিচে কিছু সাধারণ লক্ষণ তুলে ধরা হলো:

  • মুখের মধ্যে আঠালো ও শুষ্ক অনুভূতি
  • বারবার তৃষ্ণা পাওয়া
  • মুখের মধ্যে ফুস্করি বা ঠোঁটে ফাটল দেখা দেওয়া
  • গলাতে শুষ্ক অনুভূতি
  • শুষ্ক, লাল, আঁচড় কাটা জিহ্বা
  • কথা বলতে, খাবার চিবাতে ও গিলতে সমস্যা হওয়া
  • নাকের ছিদ্রের ভিতরের অংশ শুকিয়ে অস্বস্তি
  • নিঃশ্বাসে গন্ধ

মুখের শুষ্কতার প্রতিকার

১. পর্যাপ্ত পানি পান

মুখ ও জিহ্বা শুকিয়ে যাওয়া বা মুখের শুষ্কতা দূর করার জন্য প্রচুর পানি পান করা জরুরি। এটি মুখে লালার প্রাকৃতিক প্রবাহ বজায় রাখে এবং শুষ্কতা কমাতে সাহায্য করে।

২. ফ্লোরাইড সমৃদ্ধ টুথপেস্ট ব্যবহার

ফ্লোরাইড সমৃদ্ধ টুথপেস্ট দিয়ে ব্রাশ করা দাঁতের স্বাস্থ্য বজায় রাখে এবং মুখে শুষ্কতা কমাতে সহায়ক।

৩. চিনি-মুক্ত লজেন্স, ক্যান্ডি বা চুইংগাম

চিনি-মুক্ত লজেন্স, ক্যান্ডি বা চুইংগাম মুখের লালা উৎপাদন বৃদ্ধি করে। বিশেষ করে জাইলিটল সমৃদ্ধ পণ্যগুলি লালা উৎপাদনে সহায়ক।

৪. ফাস্ট ফুড এড়ানো

ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবার মুখের শুষ্কতা বাড়াতে পারে। তাই এসব খাবার এড়ানো উচিত।

৫. নাক দিয়ে শ্বাস নেয়া

মুখ দিয়ে শ্বাস নিলে মুখের শুষ্কতা বৃদ্ধি পায়। তাই যতটা সম্ভব নাক দিয়ে শ্বাস নেয়া উচিত।

৬. কৃত্রিম লালা বা মাউথ জেল ব্যবহার

মুখের শুষ্কতা কমাতে কৃত্রিম লালা বা মাউথ জেল ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলি মুখের আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

৭. রুম ভ্যাপারাইজার ব্যবহার

রুমের বায়ুতে আর্দ্রতা বৃদ্ধির জন্য একটি রুম ভ্যাপারাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি মুখের শুষ্কতা কমাতে সহায়ক।

শুষ্ক মুখের স্বাস্থ্য সমস্যা

শুষ্ক মুখের কারণে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। লালা মুখের ব্যাকটেরিয়া নিয়ন্ত্রণ করে এবং দাঁতের ক্ষয় রোধ করে। লালা না থাকলে দাঁত ও মাড়ি সংক্রমণ, মুখের ঘা, ফাঙ্গাল ইনফেকশন, ও কথা বলার সমস্যা হতে পারে।

মুখের শুষ্কতা প্রতিরোধের অন্যান্য উপায়

১. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গ্রহণ করুন। শাকসবজি ও ফলমূল বেশি খান এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন।

২. নিয়মিত দাঁতের যত্ন

নিয়মিত দাঁতের যত্ন নিন। দিনে দুইবার ব্রাশ করুন এবং ফ্লস ব্যবহার করুন।

৩. ধূমপান ও তামাক বর্জন

ধূমপান ও তামাক মুখের শুষ্কতা বৃদ্ধি করে। এসব অভ্যাস ত্যাগ করুন।

৪. সঠিক ওষুধের ব্যবহার

যদি কোনো ওষুধ মুখের শুষ্কতার কারণ হয়, তবে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ডাক্তার আপনাকে ওষুধ পরিবর্তন বা ডোজ সমন্বয় করতে পারেন।

৫. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট

স্ট্রেস ও উদ্বেগ কমানোর চেষ্টা করুন। মেডিটেশন, যোগব্যায়াম বা নিয়মিত ব্যায়াম করুন।

মুখের শুষ্কতার দীর্ঘমেয়াদি প্রতিকার

মুখের শুষ্কতা দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিকারও গুরুত্বপূর্ণ। এসব প্রতিকারে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার পাশাপাশি সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা উচিত।

১. ডাক্তার বা দাঁতের ডাক্তারের পরামর্শ

মুখের শুষ্কতা দূর করতে ডাক্তার বা দাঁতের ডাক্তারের পরামর্শ নিন। তারা আপনাকে সঠিক প্রতিকার ও চিকিৎসা প্রদান করতে পারেন।

2. আর্দ্র পরিবেশে বসবাস

যথাসম্ভব আর্দ্র পরিবেশে থাকার চেষ্টা করুন। শীতকালে ঘরে হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করুন।

৩. সুগন্ধী বা অ্যালকোহল ভিত্তিক মাউথওয়াশ এড়িয়ে চলা

সুগন্ধী বা অ্যালকোহল ভিত্তিক মাউথওয়াশ মুখের শুষ্কতা বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই এগুলি এড়িয়ে চলুন।

শেষকথা

মুখের শুষ্কতা একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এটি অবহেলা করা উচিত নয়। এর ফলে মুখের অভ্যন্তরে নানা রোগের সৃষ্টি হতে পারে। তাই, মুখের শুষ্কতা দেখা দিলে দ্রুত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সঠিক ওষুধের ব্যবহার, ও নিয়মিত দাঁতের যত্ন মুখের শুষ্কতা প্রতিরোধে সহায়ক। যে কোনো সমস্যায় ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করুন। মুখের শুষ্কতা দূর করার মাধ্যমে আপনি আপনার মুখের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারেন এবং দৈনন্দিন জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারেন।

Leave a Comment