অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগের নাম খোস পাঁচড়া খুঁজলি। এ রোগের সঙ্গে শীতের বা বাতাসের আর্দ্রতার সরাসরি কোনো সম্পর্ক আছে বলে পরিষ্কার প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপরও, শীতকালে ব্যাপকভাবে এ রোগে আক্রান্ত হতে অনেককেই দেখা যায়। বিশেষ করে, শিশুরা খুঁজলি রোগে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়।
খুঁজলি বা খোসপাঁচড়া রোগ কি?
খুজলি বা খোসপাঁচড়া খুবই বিরক্তিকর ও বিব্রতকর এবং পরিচিত একটি রোগের নাম। এটি আসলে একটি চর্মজনিত সংক্রামক রোগ। ইংরেজিতে একে বলা হয় স্ক্যাবিস (Scabies)। এটি সারকপটিস স্ক্যাবি নামক ক্ষুদ্র মাইট দ্বারা সৃষ্টি হয়ে থাকে। মাইট উকুনের থেকে ছোট একটি জীবাণু।
এটি ত্বকের পাতলা আবরণের মধ্যে বাসা বাঁধে এবং পরে ডিম পাড়ে। এটি কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া নয়। যদিও খোসপাঁচড়া বা ফোট খুঁজলি রোগ কোনো মারাত্মক অসুখ নয় কিন্তু এটি একটি সংক্রামিত চর্মরোগ। তাই আপনার কাছে অনুরোধ থাকবে, খোস পাঁচড়া হলে সাথে সাথেই অভিজ্ঞ একজন চিকৎসকের দ্বারা চিকিৎসা করানো। নতুবা আপনার কারনে আপনার পরিবার বা সমাজের অন্যান্যরাও সংক্রামিত হতে পারেন।
খুঁজলি বা খোসপাঁচড়া যেভাবে ছড়ায়
ছোঁয়াচে বলে এ রোগে পরিবারের অন্যরা খুব সহজেই সংক্রমিত হতে পারেন। সংক্রামক এ রোগটি দ্রুত অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ার কারণ হলো। একই বিছানায় একত্রে ঘুমালে বা ঘনিষ্ঠ সহচার্য, একই কাপড়-চোপড়, তোয়ালে, বালিশ বা চাদর ব্যবহার করলে একজন থেকে আরেকজনে দ্রুত এ রোগ ছড়ায়। কারণ স্ক্যাবি শরীরের বাইরে অর্থাৎ কাপড়-চোপড়, কাঁথা-বালিশ, বিছানা, তোয়ালে বা চাদরে ২-৩ দিন বেঁচে থাকতে পারে। প্রথমে এটি হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে আক্রান্ত হয় সাধারণত। সেখানে ফুসকুড়ির মতো লাল লাল দানা দেখা যায়। এরপর হাতের কনুইতে এবং বগল আক্রান্ত হয়। পরে সেটি নাভির কাছে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
খুঁজলি বা খোসপাঁচড়ার উপসর্গ
এ রোগের প্রধান উপসর্গ হলো, শরীর ভীষণ ও তীব্র চুলকানো। প্রথমে এটি ফুসকুড়ির মতো লাল লাল দানা দেখা যায়। একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন, আক্রান্ত স্থানে ছোট ছোট দানা অথবা পানিযুক্ত ছোট ছোট দানা থাকে এবং এই দানা বা ফুসকুড়ি যুক্ত অঞ্চলই হল খুঁজলি রোগের আবাসস্থল এবং এখানেই তারা বাসা বা্ধে এবং ডিম পাড়ে।
কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়, সোজা বা সামান্য বাঁকানো রেখা আবার কালো সুতার মতো ছোট ছোট রেখা দেখতে পাওয়া যায়। এসব রেখার শেষ ভাগে ছোট ছোট দানা থাকে অথবা পানিযুক্ত ছোট ছোট দানা দেখতে পাওয়া যায়। স্কাবি যখন ডিম পাড়ে তখন এক ধরনের তরল পিচ্ছিল পদার্থ বের হয় আর তখনই শরীরে চুলকানি শুরু হয়।
চুলকানোর ফলে নখের আঁচড়ে অনেকের শরিরের চামড়া উঠে যায়। এবং শরিরে আঁচড়ের দাগের সৃষ্টি হয়। চুলকাতে চুলকাতে অনেকের ত্বক ছিঁড়ে যায়, রক্ত বের হয়। এরফলে সে জায়গায় ঘা বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণও হতে পারে।
শরীরের যেসব স্থানে খুঁজলি হয়
সারা শরীরেই খুঁজলি হতে পারে। বিশেষ করে হাত, হাতের আঙুলের ফাঁকে, কবজি, কনুই, বগল, স্তন, স্তনের বোঁটা, নাভি, তলপেট, যৌনাঙ্গের আশপাশ, পশ্চাদ্দেশ, শরীরের ভাঁজসহ বিভিন্ন স্থান আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
এছাড়া পুরুষেদের যৌনাঙ্গের অগ্রভাগ এবং শিশুদের মাথা–মুখে-গাল, হাত-পায়ের তলা, মাথা, ঘাড় আক্রান্ত হতে দেখা যায়। চুলকাতে চুলকাতে অনেকে ত্বক ছিঁড়ে ফেলেন, রক্ত বের করে ফেলেন। এতে ঘা বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণও হতে পারে।
খুঁজলি বা খোসপাঁচড়া রোগের চিকিৎসা
আপনি এ রোগে আক্রান্ত হলে অবশ্যই একজন রেজিস্টারড চিকৎসকের দ্বারা চিকিৎসা করানো উচিত। এছাড়া সাধারণ কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এ রোগ সম্পুর্ণভাবে এড়ানো সম্ভব। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়মিত ব্যবহার্য জিনিস আলাদা আলাদা ব্যবহার করা উচিত।
পাঁচড়া বা খুঁজলি হলে আমরা অনেকেই ফার্মেসী থেকে ২৫ শতাংশ বেনজাইল বেনজয়েট, পারমিথ্রিন, টেটমোসল, এন্টিহিস্টামিন বা করটি-কস্টারয়েড জাতীয় ক্রিম লাগিয়ে ভাল হয়ে যাই মনে করি। কিন্তু বাস্তবতা সম্পুর্ন ভিন্ন। কারন, এ জাতীয় মলম শুধুমাত্র শরীরের আক্রান্ত স্থানের চুলকানি কমায় কিন্তু খুঁজলি পাঁচড়ার পোকা বা তার ডিম কে নষ্ট করতে পারেনা। এবং অনেকের ক্ষেত্রে ভাল হওয়ার পরিবর্তে মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে শিশুদের।
তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী জীবাণু নষ্ট হয় এ জাতীয় ক্রিম ব্যাবহার করলে তা কমে যাবে এবং ওষধ ব্যবহারের পাশাপাশি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ও কাপড়-চোপড় গরম পানি দিয়ে ভাল করে দুতে হবে এবং ৪-৫ ঘন্টা রোদে দিতে হবে তাহলে নতুন করে আবার হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
খুঁজলি খোস পাঁচড়া রোগের ঔষধ
খুঁজলি বা খোসপাঁচড়া (স্ক্যাবিস) চুলকানি রোগের জন্য বিভিন্ন ধরনের ঔষধ বাজারে পাওয়া যায়। নিচে কিছু সাধারণ ঔষধের তালিকা দেওয়া হলো:
টপিক্যাল (মলম বা লোশন) ঔষধ:
- পারমেথ্রিন (Permethrin) 5% ক্রিম: খোস-পাঁচড়া বা স্ক্যাবিস রোগে এটি সবচেয়ে প্রচলিত এবং কার্যকরি ঔষধ। ফার্মেসিতে পার্মিশল ৩০, স্ক্যাবেক্স ৫% ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। তবে এর জেনেরিক্স হল পেরমেথ্রিন ৫ %। এই মলমটি শরীরে মাখানোর পর ৮ থেকে ১৪ ঘণ্টা রেখে দিতে হয়, তারপর ধুয়ে ফেলতে হয়।
- লিন্ডেন (Lindane) 1% লোশন: খোস-পাঁচড়া বা স্ক্যাবিস রোগে এটি একটি বিকল্প ঔষধ, তবে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে এবং শিশুদের ও গর্ভবতী মহিলাদের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয় না।
- ক্রোটামিটন (Crotamiton) 10% ক্রিম: এটি স্ক্যাবিস বা খোসপাঁচড়ার জন্য ব্যবহৃত হয়, তবে কার্যকারিতা পারমেথ্রিনের মতো নয়।
- সালফার (Sulfur) ointment: বিভিন্ন কনসেনট্রেশনে (5-10%) ব্যবহার করা যায়, এটি সাধারণত গর্ভবতী মহিলাদের জন্য নিরাপদ।
মুখে খাওয়ার ঔষধ:
- আইভারমেকটিন (Ivermectin) ট্যাবলেট: এটি সাধারণত গুরুতর খোস-পাঁচড়া বা স্ক্যাবিস রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত দুই ডোজ দেওয়া হয়, প্রথম ডোজের পর এক সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ।
অন্যান্য ব্যবস্থা:
- অ্যান্টিহিস্টামিন: খুঁজলির কারণে যে চুলকানি হয়, তা কমানোর জন্য ব্যবহার করা হয়।
- স্টেরয়েড ক্রিম: চুলকানি ও প্রদাহ কমাতে ব্যবহৃত হতে পারে।
ব্যবহারের নির্দেশনা:
- প্রতিটি ঔষধ ব্যবহার করার আগে ডাক্তার বা ফার্মাসিস্টের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
- মলম সাধারণত সমস্ত শরীরেই মাখাতে হয়, মাথা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত, বিশেষ করে আঙুলের ফাঁক, নাভি, যৌনাঙ্গ ও নিতম্বের ফাঁকে। এবং গুরুতর খোস-পাঁচড়া বা স্ক্যাবিস রোগীর ক্ষেত্রে মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট ব্যবহার হয়।
- বাড়ির অন্যান্য সদস্যদেরও পরীক্ষা করা এবং প্রয়োজনে চিকিৎসা নেওয়া উচিত, কারণ খোসপাঁচড়া ছোঁয়াচে।
খোসপাঁচড়া রোগের চিকিৎসায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং নিয়মিত ব্যবহৃত জিনিসপত্রের (যেমন পোশাক, বিছানার চাদর) পরিষ্কার রাখাও গুরুত্বপূর্ণ।