ক্যানসার প্রতিরোধে খাদ্যাভ্যাস

সংযমী খাদ্যাভ্যাস একটি সুস্থ, সুন্দর ও উপভোগ্য জীবনের প্রধান উপাদান। গবেষণায় জানা যায়, সঠিক খাদ্যাভ্যাস গ্রহণের মাধ্যমে প্রায় ৭০ শতাংশ ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। ক্যানসার নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণা আমাদের সামনে এমন কিছু খাবারের তালিকা উপস্থাপন করেছে, যেগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে কিছু খাবার আছে যেগুলো ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়।

যা খাওয়া যাবে না: ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস

ধূমপান ও মদ্যপান

ধূমপান ও মদ্যপানের ফলে ক্যানসারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ধূমপানে ফুসফুস, মুখ, গলা ও খাদ্যনালীর ক্যানসারের সম্ভাবনা থাকে। মদ্যপান লিভার, স্তন, মুখ ও গলার ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।

চিনি এবং প্রক্রিয়াজাত শর্করা

প্রক্রিয়াজাত খাবারে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে, যার ফলে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। চিনি এবং অল্প পরিমাণে আঁশ ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার থেকে দূরে থাকা উচিত। এসব খাবার ওজন বৃদ্ধি, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স এবং ক্রনিক ইনফ্লামেশনের কারণে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।

প্রক্রিয়াজাত মাংস

প্রক্রিয়াজাত মাংসে ক্যানসার সহায়ক কার্সিনোজেন পদার্থ থাকে। বিশেষ করে হ্যাম, সসেজ, সালামি এবং বেকনের মতো প্রক্রিয়াজাত মাংস খাওয়ার ফলে কোলোরেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

উচ্চতাপে রান্না করা খাবার

উচ্চতাপে তৈরি করা ঝলসানো খাবার, ফ্রায়েড বা বারবিকিউয়ের মতো খাবার থেকে বিরত থাকা উচিত। এ ধরনের খাবার রান্নার সময় ক্ষতিকর পদার্থ সৃষ্টি হতে পারে, যা ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।

দুধ

যদিও দুধ প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার, তবু অতিরিক্ত দুধপান প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

প্লাস্টিক পেপার

মাইক্রোওয়েভ ওভেনে খাবার গরম করার সময় প্লাস্টিক পেপারে মোড়ানো খাবার গরম করা যাবে না। প্লাস্টিকের মধ্যে থাকা রাসায়নিক পদার্থ খাবারের সঙ্গে মিশে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

জিনগত রূপান্তরিত খাবার

যথাসম্ভব জিনগত রূপান্তরিত (Genetically Modified) খাবার পরিহার করা উচিত। যদিও এই বিষয়ে গবেষণা এখনও চলছে, তবে এই খাবারগুলোর মধ্যে ক্যানসার সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকতে পারে।

যা খাওয়া যাবে: স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

শাকসবজি ও ফলমূল

শাকসবজি ও ফলমূলের মধ্যে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। যেমন গাজর, ব্রকলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, আপেল, কমলালেবুসহ ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলমূল ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। ব্রকলি এবং বাঁধাকপি সুলফোরাফেন নামক একটি যৌগ সমৃদ্ধ, যা ক্যানসারের কোষের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে।

তিসি বীজ

তিসি বীজে রয়েছে লিগনান নামক উপাদান, যা ক্যানসার কোষের বিস্তার রোধে সহায়তা করে। নিয়মিত তিসি বীজ খেলে স্তন এবং প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি কমে।

মসলা

দারুচিনি এবং হলুদে রয়েছে ক্যানসারনিরোধী উপাদান। হলুদের মধ্যে কুরকুমিন নামে একটি সক্রিয় উপাদান রয়েছে, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রদাহনাশক গুণাবলীর কারণে ক্যানসারের বিরুদ্ধে কাজ করে।

কলাই

মটরশুঁটিতে পর্যাপ্ত আঁশ রয়েছে, যা কলোরেক্টাল ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়তা করে। অন্যান্য ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারও অন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বাদাম

নিয়মিত বাদাম খাওয়ার ফলে ক্যানসারের ঝুঁকি কমে। বাদামে থাকা স্বাস্থ্যকর চর্বি, প্রোটিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক।

জলপাই তেল ও রসুন

জলপাই তেল এবং রসুন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। রসুনের মধ্যে থাকা সালফার যৌগগুলো ক্যানসার কোষের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

মাছ

মাছে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ক্যানসার প্রতিরোধে কার্যকরী। বিশেষ করে স্যামন, ম্যাকেরেল এবং সার্ডিনের মতো তেলযুক্ত মাছ খেলে স্তন, প্রস্টেট এবং কোলোরেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকি কমে।

দুধ

নির্দিষ্ট মাত্রায় দুধপান স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হতে পারে। দুধে থাকা ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করে এবং কোলোরেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়।

আরো কিছু উপকারী টিপস

পর্যাপ্ত পানি পান

শরীরের সব কার্যক্রম ঠিক রাখতে পানি অপরিহার্য। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করলে শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বেরিয়ে যায়, যা ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।

চা

গ্রিন টি এবং অন্যান্য ভেষজ চা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক। প্রতিদিন এক বা দুই কাপ গ্রিন টি পান করা ভালো।

পর্যাপ্ত ঘুম

পর্যাপ্ত ঘুমের মাধ্যমে শরীরের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া কার্যকর হয়, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়।

মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন

মানসিক চাপ ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই নিয়মিত ধ্যান, যোগব্যায়াম এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করার মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানো উচিত।

শেষ কথা

ক্যানসার প্রতিরোধে খাদ্যাভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রায় ৭০ শতাংশ ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ খাবারগুলো থেকে দূরে থাকা উচিত। এই নিবন্ধে উল্লিখিত খাদ্যাভ্যাস গ্রহণ করলে আপনি একটি সুস্থ, সুন্দর ও উপভোগ্য জীবনযাপন করতে পারবেন।

সঠিক খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চা, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং মানসিক চাপ কমানোর জন্য বিভিন্ন উপায় গ্রহণ করা উচিত। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য পরিবারের সবার সঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করা উচিত।

Leave a Comment