ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (KMC): প্রি-ম্যাচিউর নবজাতকের জীবনের নতুন আলো

১৯৭৮ সালে কলম্বিয়ার চিকিৎসক নাথালি চারপাকের প্রচেষ্টায় ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (KMC) পদ্ধতি চালু হয়, যা আজ বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। প্রি-ম্যাচিউর বা অপরিণত নবজাতকের জীবনের জন্য KMC ইনকিউবেটরের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর এবং সাশ্রয়ী। আসুন, এই পদ্ধতি এবং এর বিভিন্ন সুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।

ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (KMC) পদ্ধতি কী?

ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার বা KMC হলো একটি সহজ ও কার্যকর পদ্ধতি যা অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করা নবজাতকের জীবন রক্ষায় সাহায্য করে। এই পদ্ধতিতে নবজাতককে মায়ের বা পরিবারের অন্য সদস্যদের বুকের মধ্যে রেখে মাতৃদেহের উষ্ণতায় বড় করে তোলা হয়। ক্যাঙ্গারু মায়ের বুকের উষ্ণতা, মায়ের দুধ খাওয়ানো, এবং মায়ের সাথে নিবিড় বন্ধন নবজাতকের দ্রুত সুস্থ হওয়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।

KMC পদ্ধতি মূলত তিনটি মূল উপাদানের উপর ভিত্তি করে কাজ করে:

  1. ত্বকে-ত্বকে সংযোগ: নবজাতককে মায়ের বুকে সরাসরি ত্বকের সংস্পর্শে রাখা হয়।
  2. মাতৃদুগ্ধপান: প্রয়োজন অনুযায়ী শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো হয়।
  3. মায়ের সাথে নিবিড় বন্ধন: মায়ের সাথে শিশুর নিবিড় বন্ধনের মাধ্যমে শিশু নিরাপত্তা ও স্নেহ পায়।

ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (KMC) পদ্ধতির সুবিধা

KMC পদ্ধতির অসংখ্য সুবিধা রয়েছে, যা প্রি-ম্যাচিউর নবজাতকের জীবন রক্ষায় অমূল্য ভূমিকা পালন করে:

  1. শারীরিক তাপমাত্রা বজায় রাখা: মায়ের বুকের উষ্ণতা নবজাতকের শারীরিক তাপমাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে, যা ইনকিউবেটরের চেয়ে প্রাকৃতিক এবং কম খরচে করা যায়।
  2. মাতৃদুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধি: মায়ের দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, যা শিশুর পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
  3. শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎপিণ্ডের কার্যক্রম উন্নতি: ত্বকে-ত্বকে সংযোগ নবজাতকের শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎপিণ্ডের কার্যক্রম উন্নত করে এবং মৃত্যুঝুঁকি কমায়।
  4. মায়ের সাথে নিবিড় বন্ধন: মায়ের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা নবজাতকের মানসিক ও সামাজিক বিকাশে সহায়ক।
  5. সহজে মা ও শিশুর সমস্যা চিহ্নিতকরণ: মায়ের কাছে থাকায় শিশুর কোনো সমস্যা হলে তা দ্রুত শনাক্ত করা যায় এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হয়।
  6. খরচ সাশ্রয়ী: KMC পদ্ধতি ইনকিউবেটরের চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী এবং সুবিধাজনক।

কারা ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (KMC) পদ্ধতিতে উপকৃত হতে পারে?

ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার বিশেষত নিম্নোক্ত পরিস্থিতিতে নবজাতকদের জন্য কার্যকর:

  1. প্রি-ম্যাচিউর নবজাতক: ৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম নেওয়া নবজাতকরা।
  2. কম ওজনের নবজাতক: আড়াই কেজির কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুরা।
  3. শ্বাসকষ্ট: জন্মের পর শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে এমন নবজাতক।
  4. ইনফেকশন: নবজাতকের শরীরে সংক্রমণ।
  5. জন্ডিস: নবজাতক জন্ডিসে আক্রান্ত হলে।

বাংলাদেশে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (KMC) এর প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় সোয়া চার লাখ প্রি-ম্যাচিউর নবজাতক জন্মগ্রহণ করে। এসব অপরিণত শিশুর মৃত্যুহার কমানোর জন্য KMC পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রি-ম্যাচিউর শিশুর জন্মের জন্য নিম্নোক্ত কারণগুলো বিশেষভাবে দায়ী:

  1. বাল্যবিয়ে: কিশোরী বয়সে বিয়ে হওয়া।
  2. মায়ের স্বাস্থ্য সমস্যা: যেমন অ্যাজমা, ডায়াবেটিস।
  3. গর্ভাবস্থার সমস্যা: গর্ভাবস্থায় পানি আগে ভাঙা, রক্তপাত, ধূমপান বা তামাক গ্রহণ করা।
  4. অপ্রতুল পুষ্টি: মায়ের পুষ্টির অভাব।

ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতির মাধ্যমে এ সকল ঝুঁকিপূর্ণ নবজাতকের মৃত্যুহার কমানো সম্ভব।

ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (KMC) পদ্ধতির প্রচলন ও গ্রহণযোগ্যতা

বিশ্বব্যাপী ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, সুইডেন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, যেখানে ইনকিউবেটরের সুবিধা সীমিত, সেখানে KMC পদ্ধতি বিশেষভাবে কার্যকর।

ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (KMC) পদ্ধতি গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি

  1. বিশেষ বেড বা চেয়ার: যাতে মা এবং শিশু আরামদায়কভাবে থাকতে পারে।
  2. মায়ের স্বাস্থ্য সচেতনতা: মায়ের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং যথাযথ পুষ্টি গ্রহণ করতে হবে।
  3. সঠিক প্রশিক্ষণ: মায়েদের KMC পদ্ধতির সঠিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।

ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (KMC) পদ্ধতি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ

কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যেমন:

  1. সচেতনতার অভাব: অনেক মা ও পরিবার এখনও KMC পদ্ধতির সম্পর্কে সচেতন নয়।
  2. স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অভাব: প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অভাব।
  3. প্রশিক্ষণের অভাব: মায়েদের সঠিক প্রশিক্ষণের অভাব।

এই চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

শেষকথা

ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (KMC) পদ্ধতি প্রি-ম্যাচিউর নবজাতকের জীবন রক্ষায় একটি অত্যন্ত কার্যকর ও সাশ্রয়ী পদ্ধতি। ইনকিউবেটরের বিকল্প হিসেবে এই পদ্ধতি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটি বিশেষভাবে কার্যকর। মায়ের সাথে নবজাতকের নিবিড় বন্ধন, উষ্ণতা, এবং মাতৃদুগ্ধ পানের মাধ্যমে নবজাতকের দ্রুত সুস্থতা এবং মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে KMC পদ্ধতির প্রচলন ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নবজাতকের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হবে।

Leave a Comment