অনেকের ধারণা, স্ট্রোকের ঝুঁকি শুধুমাত্র বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যদিও এই ধারণা কিছুটা সঠিক, বর্তমান সময়ে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের মধ্যেও স্ট্রোকের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। আমেরিকান স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে মোট স্ট্রোক রোগীর ১০ শতাংশের বয়স এখন ৪৫ বছরের কম। বৈশ্বিক পরিস্থিতিও একই রকম। কম বয়সে স্ট্রোক হওয়া ব্যক্তিদের ‘স্ট্রোক ইন ইয়াং’ বলা হয়। এই বয়সসীমা পারিবারিক, সামাজিক, এবং পেশাজীবনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উৎপাদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অকালে স্ট্রোকের কারণে অল্প বয়সী অনেকেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে অসহায় জীবনযাপন করছেন, এবং কেউ কেউ অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন।
কম বয়সে কেন স্ট্রোক হয়?
অল্প বয়সে স্ট্রোকের প্রধান কারণ হলো হৃদ্রোগ। এ ছাড়া মস্তিষ্কের রক্তনালির জন্মগত ত্রুটি, স্থূলতা, রক্তে কোলেস্টেরলের উচ্চমাত্রা, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, ও উচ্চ রক্তচাপও স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। বিভিন্ন নেশা, বিশেষ করে মেথ এম্ফিটামিনের (ইয়াবা) আসক্তি থাকলে রক্তনালি ছিঁড়ে স্ট্রোক হতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের দীর্ঘ মেয়াদে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন অথবা ‘অ্যান্টি ফসফোলিপিড সিনড্রোম’ নামক বাতরোগও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এছাড়াও, জন্মগতভাবে ত্রুটিযুক্ত রক্তনালি ছিঁড়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
লক্ষণ ও করণীয়
স্ট্রোকের লক্ষণ সব বয়সের জন্য একই রকম—হঠাৎ মুখ বাঁকা হয়ে যাওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া, অথবা এক দিকের হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এমনকি কেউ কেউ অচেতনও হয়ে পড়তে পারেন এবং খিঁচুনি হতে পারে। স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দিলেই দ্রুত মাথার সিটি স্ক্যান অথবা এমআরআই করা জরুরি। তরুণ বয়সে স্ট্রোকের কারণ নির্ণয়ের জন্য ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, ডায়াবেটিস, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। রক্তনালির জন্মগত সমস্যা নির্ণয়ের জন্য মস্তিষ্কের এনজিওগ্রাম করাও লাগতে পারে।
চিকিৎসা
বাংলাদেশে স্ট্রোকের অত্যাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই কারও স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দিলে অপেক্ষা না করে দ্রুত হাসপাতালে যোগাযোগ করা উচিত। যত দেরি হবে, সফলতার হার তত কমে যাবে।
তরুণ বয়সে স্ট্রোকের পেছনে সাধারণত কোনো না কোনো নির্দিষ্ট কারণ থাকে। রোগীর ইতিহাস এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে স্ট্রোকের কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং এর চিকিৎসা করতে হবে। পক্ষাঘাতগ্রস্ততা উন্নতির জন্য ফিজিওথেরাপির ভালো ভূমিকা রয়েছে। মস্তিষ্কের রক্তনালির জন্মগত সমস্যার সমাধানে অনেক সময় শল্যচিকিৎসারও প্রয়োজন হতে পারে।
প্রতিরোধ ও জীবনযাপন
কম বয়সে স্ট্রোক প্রতিরোধ করার জন্য পরিমিত খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, ও দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন গুরুত্বপূর্ণ। ধূমপানসহ যেকোনো প্রকার নেশাকে না বলা উচিত। হৃৎপিণ্ডের যেকোনো জন্মগত ছিদ্র বা ভালভের সমস্যা থাকলে দ্রুত চিকিৎসা করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অনেকাংশেই কম বয়সে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
স্ট্রোক প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
স্ট্রোক প্রতিরোধে কিছু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে আলোচনা করা যাক:
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: বছরে অন্তত একবার সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, এবং কোলেস্টেরল লেভেল নিয়মিত মনিটর করা উচিত।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: কম চর্বি এবং কম কোলেস্টেরলযুক্ত খাদ্যগ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল খাদ্যতালিকায় রাখা উচিত।
- ব্যায়াম: সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট ব্যায়াম করা উচিত। হাঁটা, সাঁতার, এবং সাইক্লিং এর মতো কার্যকলাপ স্ট্রোক প্রতিরোধে সহায়ক।
- মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন: মানসিক চাপ কমাতে যোগ ব্যায়াম, মেডিটেশন, বা কোনো শখ নিয়ে কাজ করা যেতে পারে।
- নেশামুক্ত জীবনযাপন: ধূমপান, অ্যালকোহল, এবং অন্যান্য মাদকের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা উচিত।
সামাজিক সচেতনতা
কম বয়সে স্ট্রোক প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম, স্কুল ও কলেজে শিক্ষামূলক সেমিনার, এবং কমিউনিটিতে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা আয়োজন করে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
উপসংহার
কম বয়সে স্ট্রোকের ঝুঁকি কোনোভাবেই উপেক্ষা করা উচিত নয়। সঠিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তন, এবং সচেতনতার মাধ্যমে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ উভয় দিকেই মনোযোগ দেওয়ার মাধ্যমে তরুণদের মাঝে স্ট্রোকের হার কমানো যেতে পারে। আমাদের সকলের উচিত এই বিষয়ে সচেতন হওয়া এবং অন্যদের সচেতন করা।