প্রচণ্ড পেটব্যথা চিকিৎসাক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে একটি পরিচিত জরুরি অবস্থা। একসময় আমাদের দেশে প্রচণ্ড পেটব্যথার প্রধান কারণ ছিল গ্যাস্ট্রিক পারফোরেশন বা টাইফয়েডজনিত পারফোরেশন (অন্ত্র ছিদ্র হয়ে যাওয়া)। তবে, আজকাল উন্নত চিকিৎসা এবং সচেতনতার কারণে এসব রোগীর সংখ্যা কমে গেছে। বর্তমানে আকস্মিক প্রচণ্ড পেটব্যথার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ বা অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস।
অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস: একটি জটিল ও জরুরি সমস্যা
অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ, বিশেষ করে অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস, পেটের জটিল ও জরুরি সমস্যা হিসেবে পরিচিত। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেলে এই রোগের কারণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। পেটব্যথা দিয়ে উপসর্গ শুরু হওয়ায় অনেকেই এটিকে গ্যাস্ট্রিক ভেবে চিকিৎসকের কাছে যেতে দেরি করেন।
প্যানক্রিয়াস ও তার কার্যক্রম
অগ্ন্যাশয় বা প্যানক্রিয়াস পেটের ওপরে, পেছনের দিকে ও বাম পাশে অবস্থিত। এটি আমাদের শরীরে বিপাক ক্রিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম নিঃসরণ থেকে শুরু করে ইনসুলিনসহ নানা হরমোন তৈরি করে।
অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস কেন হয়?
অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহের কারণগুলো ভিন্ন হতে পারে। পিত্তথলি, পিত্তনালি অথবা প্যানক্রিয়াসের নালিতে পাথর থাকলে প্রদাহ হতে পারে। এছাড়াও, যাদের রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড বেশি এবং যারা মদ্যপান করেন, তাদের এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। পেটে আঘাত, অস্ত্রোপচার বা সংক্রমণ থেকেও এ রোগ হতে পারে। পারিবারিক ইতিহাস এবং স্থূলতার সঙ্গেও এর সম্পর্ক আছে।
অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের লক্ষণ
এই রোগের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে তীব্র পেটব্যথা, যা পেটের ওপরের অংশে এবং মাঝখানে শুরু হয় এবং ক্রমশ বাড়তে থাকে। সাধারণ গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ বা ব্যথানাশকে কোনো কাজ করে না। ব্যথাটি পেট থেকে পিঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে, প্রচুর বমি হতে পারে। অনেক সময় রোগী পেটব্যথার কারণে সামনের দিকে কুঁকড়ে বা কুঁজো হয়ে বসে থাকেন। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে রোগী শকে চলে যেতে পারে, যার ফলে হৃৎস্পন্দন দ্রুত হওয়া, রক্তচাপ নেমে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস নির্ণয় ও চিকিৎসা
উপসর্গ দেখা দিলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া উচিত। চিকিৎসকরা সাধারণত রক্তের কিছু পরীক্ষা (অ্যামাইলেজ, লাইপেজ) এবং কিছু ইমেজিং পরীক্ষা (পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম বা সিটি স্ক্যান) করে অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস নির্ণয় করতে পারেন।
সঠিক চিকিৎসা না করলে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে যেমন, অঙ্গ অকার্যকর হওয়া, পেটে পানি আসা, রক্ত বমি হওয়া, প্যানক্রিয়াসে সিস্ট হওয়া বা পুঁজ হওয়া ইত্যাদি। দীর্ঘমেয়াদে এই রোগের কারণে ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস এবং ডায়াবেটিস হতে পারে।
অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের চিকিৎসা
রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। এতে ব্যথানাশক ইনজেকশন, শিরায় স্যালাইন এবং প্রয়োজন হলে শিরায় অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দন, প্রস্রাবের পরিমাণ, রক্তের খনিজ লবণ, ক্যালসিয়াম, অ্যালবুমিন, সুগার ইত্যাদি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার।
প্রাথমিক ব্যথা ও ধাক্কা কাটানোর পর সমস্যার পেছনে থাকা মূল কারণটি খুঁজে বের করতে হবে। যদি পিত্তথলি, পিত্তনালি বা অগ্ন্যাশয়ের নালিতে পাথর থাকে, তবে তা দূর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। ওজন এবং ট্রাইগ্লিসারাইড বেশি থাকলে কমানো উচিত।
প্রাথমিক চিকিৎসা ও সতর্কতা
অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস একটি জরুরি সমস্যা। তীব্র ও অস্বাভাবিক পেটব্যথা হলে অযথা অন্যের পরামর্শে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ বা ব্যথানাশক খেয়ে সময় নষ্ট করবেন না। পেটব্যথার কারণ জানার জন্য জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত।
জরুরি অবস্থা মোকাবেলা
এই ধরনের জরুরি সমস্যায় দ্রুত কাছের হাসপাতাল, পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞ অথবা মেডিসিন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে। উপসর্গ শুরু হলে দ্রুত হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে সঠিক পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে।
অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের মতো গুরুতর অবস্থার জন্য প্রাথমিক সচেতনতা এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে জীবন রক্ষা করা সম্ভব। তাই এ ধরনের সমস্যা হলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলা উচিত।