শ্বেতি: কোনো ছোঁয়াচে বা মারাত্মক রোগ নয়

শ্বেতি, যা চিকিৎসা পরিভাষায় ভিটিলিগো নামে পরিচিত, একটি ত্বকের বিবর্ণজনিত রোগ যা সমাজে অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা সৃষ্টি করে। এটি ছোঁয়াচে বা মারাত্মক নয়, তবে এটি সামাজিকভাবে এবং মানসিকভাবে প্রভাব ফেলে। ডা. এম আর করিম রেজা, একজন ত্বক, সৌন্দর্য এবং সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ, এই বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন।

শ্বেতি: কী এবং কেন

শ্বেতি হলো একটি ত্বকের রোগ যেখানে ত্বকের নির্দিষ্ট স্থানে রং হালকা বা সাদা হয়ে যায়। এটি মূলত মেলানিন নামক একটি পিগমেন্টের অভাবের কারণে ঘটে। মেলানিন ত্বকের রং নির্ধারণ করে এবং এটি মেলানোসাইট নামক কোষ দ্বারা উৎপাদিত হয়। শ্বেতির কারণে মেলানিন উৎপাদন কমে গেলে বা বন্ধ হয়ে গেলে ত্বক বিবর্ণ হয়ে যায়।

শ্বেতি সাধারণত মুখ, কনুই, হাঁটু, হাত, পা এবং কোমরে বেশি দেখা যায়। ত্বকের যে কোনো স্থানে এটি দেখা দিতে পারে এবং ধীরে ধীরে বা দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করতে পারে।

শ্বেতির কারণ

শ্বেতির সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে কিছু কারণসমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো:

  1. বংশগত প্রভাব: প্রায় ১০-১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে শ্বেতি বংশগত কারণেই হয়ে থাকে।
  2. অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া: শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা মেলানিন উৎপাদনকারী কোষগুলিকে আক্রমণ করে।
  3. রোগ: থাইরয়েড, ডায়াবেটিস, বিশেষ ধরনের রক্তশূন্যতা ইত্যাদি রোগ শ্বেতির কারণ হতে পারে।
  4. পুষ্টির অভাব: খাদ্যজনিত পুষ্টির ঘাটতি শ্বেতির প্রাদুর্ভাব বাড়াতে পারে।
  5. মানসিক চাপ ও রৌদ্রতাপ: অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও সরাসরি রোদে দীর্ঘ সময় থাকা শ্বেতির কারণ হতে পারে।
  6. ওষুধ ও রাসায়নিক পদার্থ: কিছু ওষুধ এবং রাসায়নিক পদার্থ শ্বেতি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে।

শ্বেতির লক্ষণ

শ্বেতির প্রধান লক্ষণ হলো ত্বকের নির্দিষ্ট অংশের রং হালকা বা সাদা হয়ে যাওয়া। এতে কোনো শারীরিক পরিবর্তন হয় না, তবে আক্রান্ত স্থানে হালকা চুলকানি অনুভূত হতে পারে। রোগটি ধীরে ধীরে বা দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করতে পারে।

শ্বেতির চিকিৎসা

শ্বেতির কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি শ্বেতির বিস্তার কমাতে এবং মেলানিন উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করতে পারে:

  1. ঔষধ: ত্বকের জন্য নির্দিষ্ট ঔষধ ও ক্রিম ব্যবহার করা হয়।
  2. আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি এবং লেজার চিকিৎসা: আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি এবং লেজার থেরাপি শ্বেতির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
  3. কারণ নির্ণয় ও চিকিৎসা: শ্বেতির কারণ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা প্রদান করা হয়। যেমন, পুষ্টির ঘাটতি পূরণ বা থাইরয়েড রোগের চিকিৎসা।
  4. সার্জারি: মেলানিন উৎপাদনকারী কোষ মেলানোসাইট গ্রাফট বা সম্পূর্ণ স্কিন গ্রাফটের মাধ্যমে সার্জারি করা যায়।

শ্বেতি ও কুষ্ঠ: একটি ভুল ধারণা

অনেকেই শ্বেতি এবং কুষ্ঠকে একই রোগ বলে ভুল করেন। কুষ্ঠ একটি জীবাণুঘটিত সংক্রামক রোগ, যা শ্বেতির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। শ্বেতি ছোঁয়াচে নয় এবং এটি কোনো মারাত্মক রোগ নয়।

মানসিক এবং সামাজিক প্রভাব

শ্বেতি রোগীরা সাধারণত মানসিক চাপ এবং হীনমন্যতায় ভুগে থাকেন। সমাজে অনেকেই শ্বেতি রোগীদের নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন, যা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। শ্বেতি রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করা এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় উৎসাহিত করা প্রয়োজন।

উপসংহার

শ্বেতি রোগটি ছোঁয়াচে বা মারাত্মক নয়, তবে এটি মানসিক ও সামাজিকভাবে প্রভাব ফেলে। সঠিক সচেতনতা এবং সহানুভূতিশীল আচরণের মাধ্যমে শ্বেতি রোগীরা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালিয়ে যেতে পারেন। শ্বেতির লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত এবং প্রাথমিক অবস্থাতেই চিকিৎসা শুরু করা উচিত।

এটি কোনো জীবাণুঘটিত রোগ নয়, তাই আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলামেশা করা যেতে পারে। শ্বেতি রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা তাদের মানসিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারি।

Leave a Comment