ফ্যাটি লিভার বর্তমানে সবচেয়ে সাধারণ একটি Lifestyle Disorder হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর অর্থ হলো, আমাদের জীবনযাপনের ধরন ও খাদ্যাভ্যাসের জন্য এই রোগটি সৃষ্ট হচ্ছে। এটি নিরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত, যা অবহেলা করলে সিরোসিস হতে পারে। সিরোসিস হলে লিভার শুকিয়ে যায়। এর ফলে লিভার তার কার্যক্ষমতা হারায়। এরপর লিভার ফেইলর, এমনকি মৃত্যুর কারণও হতে পারে ফ্যাটি লিভার।
লিভারের ভূমিকা ও ফ্যাটি লিভারের সংজ্ঞা
লিভার আমাদের শরীরের পাওয়ার হাউজ। আমরা যা খাই, লিভার সেটিকে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলে। এটি খাদ্যকে প্রক্রিয়াকরণ করে শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে। এছাড়া, লিভার রোগ-জীবাণু ধ্বংস করে এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে।
ফ্যাটি লিভার তখন ঘটে যখন লিভারের কোষের চারপাশে চর্বি জমতে থাকে। সাধারণত লিভারে ৫ থেকে ১০ শতাংশ চর্বি থাকে। কিন্তু যদি এই পরিমাণ ১০ শতাংশের বেশি হয়ে যায়, তখন তাকে ফ্যাটি লিভার বলা হয়।
ফ্যাটি লিভারের প্রকারভেদ
ফ্যাটি লিভার মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে:
- অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার: অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনের ফলে এই ধরনের ফ্যাটি লিভার হয়।
- নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার: অ্যালকোহল ব্যতিরেকে অন্যান্য কারণে এই ফ্যাটি লিভার হয়।
ফ্যাটি লিভারের কারণসমূহ
নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারের প্রধান কারণগুলো হলো:
- স্থূলতা ও প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংস বা প্রোসেসড মিটের অতিরিক্ত সেবন।
- বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া।
- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস।
- রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেশি থাকা।
- খুব দ্রুত ওজন কমানো।
- অতিরিক্ত পরিমাণে রিফাইন্ড শর্করা গ্রহণ।
- মদ্যপান বা জেনেটিক কারণ।
ফ্যাটি লিভারের লক্ষণসমূহ
ফ্যাটি লিভার সাধারণত কোনও বিশেষ লক্ষণ ছাড়াই থাকতে পারে। কিন্তু কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখা দিতে পারে:
- কোনও কারণ ছাড়াই ভুঁড়ি বেড়ে যাওয়া।
- প্রস্রাবের রং হলুদ হওয়া ও অতিরিক্ত দুর্গন্ধ।
- মিষ্টির প্রতি অতি আসক্তি।
- অল্প পরিশ্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়া।
- অত্যাধিক দুর্বলতা ও অবসাদ।
- চুলকানি।
- চোখ ও চামড়ার রং হলুদ হয়ে যাওয়া।
- পেটে ব্যথা।
- পেটে পানি জমা।
- হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া।
ফ্যাটি লিভারের ডায়েট ও জীবনযাত্রা
ফ্যাটি লিভার কমানোর অন্যতম উপায় হলো ডায়েট এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন। লো ফ্যাট ও লো ক্যালোরি ডায়েট ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। এখানে কিছু পরামর্শ:
- ওজন কমানো: ওজন কমানো ফ্যাটি লিভারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ।
- ব্যায়াম: দৈনিক অন্তত ৪৫ মিনিট ব্যায়াম করা জরুরি।
- সুষম খাদ্য: প্রচুর ফল ও সবজি, ফাইবার বা খাদ্য আঁশ সমৃদ্ধ সবজি ও শস্য খাওয়া।
- নিয়মিত ঘুম: প্রতিদিন অন্তত ৬ ঘণ্টা ঘুমানো।
- অ্যাক্টিভ থাকা: সক্রিয় জীবনযাপন বজায় রাখা।
কোন খাবার খাবেন ও কোনগুলো বাদ দিবেন
খাবার যা খেতে হবে:
- প্রচুর ফল ও সবজি।
- ফাইবার বা খাদ্য আঁশ সমৃদ্ধ সবজি ও শস্য।
কম পরিমাণে খাবেন:
- চিনি।
- লবণ।
- রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট।
- সম্পৃক্ত ফ্যাট।
- বেকারি ফুড।
খাবার যা বাদ দিতে হবে:
- অ্যালকোহল: এটি ফ্যাটি লিভারের অন্যতম প্রধান কারণ।
- মিষ্টি জাতীয় খাবার: অতিরিক্ত মিষ্টি দিয়ে তৈরি বিস্কুট, চকোলেট, ফ্রুট জুস।
- তেলে ভাঁজা খাবার: হাই ফ্যাট ও হাই ক্যালোরি যুক্ত।
- অতিরিক্ত লবণ: অতিরিক্ত লবণ শরীরে পানি ধরে রাখে।
- লাল মাংস: গরু ও খাসির মাংস।
ফ্যাটি লিভার সনাক্তকরণের টেস্ট
ফ্যাটি লিভার সনাক্ত করতে বিভিন্ন টেস্ট করা হয়। সেগুলো হলো:
- লিভার ফাংশন টেস্ট।
- SGOT ও SGPT: এই এনজাইমগুলোর মাত্রা বেশি থাকলে।
- USG অ্যাবডোমেন: আলট্রাসাউন্ড করে দেখা।
- লিভারের MRI: প্রয়োজনে লিভারের MRI করা যেতে পারে।
ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধের উপায়
ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধে করণীয়:
- স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম খাদ্য গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ: স্থূলতা এড়াতে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
- সঠিক খাদ্যাভ্যাস: চিনি, লবণ ও রিফাইন্ড শর্করা কমিয়ে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া।
- অ্যালকোহল পরিহার: অ্যালকোহল সেবন থেকে বিরত থাকা।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: লিভারের কার্যক্রম নিয়মিত পরীক্ষা করা।
শেষকথা
ফ্যাটি লিভার একটি Lifestyle Disorder রোগ যা সচেতনতা এবং সঠিক জীবনযাপনের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম এবং অ্যালকোহল পরিহার করে এই রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা করা সম্ভব।