রক্তস্বল্পতা বা এনেমিয়া হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যায়। এটি শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পৌঁছানোর ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়, ফলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশে প্রচুর মানুষ, বিশেষ করে নারীরা, এই সমস্যায় ভুগছেন। তবে কিছু নির্দিষ্ট খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করা যায়। আসুন জেনে নিই রক্তস্বল্পতা দূর করার জন্য কার্যকর কিছু খাবার ও উপায় সম্পর্কে।
রক্তস্বল্পতা দূর করার জন্য কার্যকর কিছু খাবার ও উপায়
ফলমূল
ফলমূলে প্রচুর আয়রন এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থাকে যা রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- আপেল: প্রতিদিন একটি আপেল খেলে রক্তশূন্যতার প্রকোপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
- টমেটো: এতে আয়রন, ভিটামিন সি এবং লাইকোপেন রয়েছে যা রক্তস্বল্পতা দূর করতে সহায়তা করে।
- বেদানা: এটি আয়রনের ভাল উৎস এবং রক্ত তৈরি করতে সাহায্য করে।
- কল: পটাশিয়াম সমৃদ্ধ এই ফলটি শরীরের আয়রন শোষণে সহায়তা করে।
- কমলা ও আঙ্গুর: ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এই ফলগুলো আয়রনের শোষণ বাড়ায়।
- গাজর: এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে বিটা-ক্যারোটিন যা রক্তশূন্যতা কমাতে কার্যকর।
শাকসবজি
শাকসবজিতে প্রচুর আয়রন এবং ফলিক অ্যাসিড থাকে যা রক্তের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়াতে সহায়তা করে।
- পালং শাক: আয়রনের ভাল উৎস যা হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায়।
- বিট: রক্ত তৈরিতে বিট খুবই কার্যকর।
- কচু শাক ও লতি: এই শাকসবজিতে প্রচুর আয়রন এবং ফলিক অ্যাসিড থাকে।
- ব্রকোলি: এতে রয়েছে আয়রন, ভিটামিন সি এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান।
- ধনিয়া ও পুদিনা পাতা: এগুলো আয়রনের ভাল উৎস এবং খাবারের স্বাদ বাড়ায়।
প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার
প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারগুলো রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- কলিজা: খাসি বা গরুর কলিজায় প্রচুর আয়রন এবং ভিটামিন বি থাকে।
- মাছ: বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ ও ছোট মাছ আয়রনের ভাল উৎস।
- ডিম: ডিমের কুসুমে আয়রন এবং প্রোটিন থাকে যা রক্ত তৈরি করে।
- ডাল: মসুর, মুগ এবং মাসকলাইয়ের ডালে প্রচুর ফোলেট থাকে যা রক্তস্বল্পতা কমায়।
- সয়াবিন: এতে রয়েছে উচ্চমাত্রায় আয়রন এবং ভিটামিন যা রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে কার্যকর।
বাদাম ও বীজ
বাদাম ও বীজে প্রচুর আয়রন এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থাকে যা রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে সহায়তা করে।
- চীনাবাদাম: প্রতিদিন চীনাবাদাম খেলে রক্তস্বল্পতা কমে।
- তিলের বীজ: আয়রন সমৃদ্ধ এই বীজগুলো রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে কার্যকর।
অন্যান্য খাবার
রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে অন্যান্য কিছু খাবারও খুবই কার্যকর।
- খেজুর: খেজুরে রয়েছে প্রচুর আয়রন যা রক্তশূন্যতা কমাতে সাহায্য করে।
- দুধ: দুধে ভিটামিন, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম থাকে যা হিমোগ্লোবিন বাড়াতে সাহায্য করে।
- মধু: মধুতে আয়রন, কপার ও ম্যাঙ্গানিজ থাকে যা হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে সহায়তা করে।
- লাল বিটরুটের জুস: এটি রক্তের অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করে।
- আমলার জুস: এটি আয়রন শোষণে সহায়তা করে এবং রক্তস্বল্পতা কমায়।
রক্তস্বল্পতার লক্ষণ
রক্তস্বল্পতা হলে শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব লক্ষণের মধ্যে রয়েছে:
- দুর্বলতা এবং অবসাদ
- মাথা ব্যথা এবং মাথা ঘোরা
- চোখে অন্ধকার দেখা
- অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে ওঠা
- বুক ধড়ফড় করা
- মেজাজ খিটখিটে হওয়া
- কাজকর্মে অনীহা
- জিহ্বা ও ঠোঁট মসৃণ ও সাদাটে হয়ে যাওয়া
- মুখের কোনায় ও জিহ্বায় ঘা হওয়া
- নখে ভঙ্গুরতা বা চামচের মতো গর্ত হওয়া
- অরুচি, বমি বমি ভাব, হজমে ব্যাঘাত ঘটা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া
যেসব অভ্যাস বদলাতে হবে
রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করা প্রয়োজন:
- খাবারের এক ঘণ্টা আগে-পরে চা, কফি বা কোমল পানীয় এড়িয়ে চলুন: এগুলো খাবারের আয়রন শোষণে বাধা দেয়।
- খালিপেটে ফল খাবেন না: ফলের ভিটামিন সি খাবারের আয়রন শোষণে সহায়তা করে।
- ইসবগুল খান খাবারের ঘণ্টা দুয়েক আগে বা পরে: নয়তো ফাইবারের ছাঁকনিতে পুষ্টির কিছুটা আটকে যেতে পারে।
- জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে চলুন: এগুলোতে পুষ্টিগুণ নেই এবং পেটের গোলমাল সৃষ্টি করে।
- মাছ, মাংস ও ডিম খাওয়ার পর দুধের খাবার এড়িয়ে চলুন: এগুলো খাবারের আয়রন শোষণে বাধা দেয়।
- রেড মিট, মাছ ও ডিম খান: এগুলো হিম-আয়রন সমৃদ্ধ যা সহজে শরীরের কাজে লাগে। আর দুধ, সবুজ শাক-সবজি, ডাল ও ফল থেকে নন-হিম আয়রন পান যা শোষিত হতে সময় লাগে।
- ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খান: লেবু, কমলা, আমলকী বা অন্য টক ফল আয়রন শোষণে সহায়তা করে।
শেষকথা
রক্তস্বল্পতা একটি সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা। তবে নিয়মিত আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় আয়রন সমৃদ্ধ ফল, শাকসবজি, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার এবং বাদাম ও বীজ অন্তর্ভুক্ত করে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন নিশ্চিত করুন। এতে করে আপনি রক্তস্বল্পতার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন এবং শরীরকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখতে পারবেন।