গলা ও বুক জ্বালাপোড়া হলো একটি সাধারণ শারীরিক সমস্যা, যা অনেক মানুষকে ভোগায়। এটি সাধারনত বুকের ভিতরের মধ্যবর্তী স্থান থেকে শুরু করে গলা পর্যন্ত জ্বালাকর অনুভূতি সৃষ্টি করে। কখনও কখনও এই জ্বালা বুকে বা গলায় সীমাবদ্ধ থাকে, আবার কখনও উভয় স্থানে হতে পারে। অনেক সময় জ্বালার সাথে ব্যথাও থাকতে পারে, যা অসহনীয় হতে পারে। এই সমস্যা কেন হয় এবং তাৎক্ষণিক কি ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা জানার চেষ্টা করা যাক।
গলা ও বুক জ্বালা-পোড়া কী?
বুক জ্বালা-পোড়া বলতে সাধারনত বুকের ভিতরের মধ্যবর্তী স্থান থেকে গলা পর্যন্ত জ্বালাকর অনুভুতি বুঝায়। এটি অনেক সময় শুধু বুকে, কখনও গলায় বা কখনও উভয় স্থানে হতে পারে। এই জ্বালা কখনও স্বল্পস্থায়ী, কখনও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। যাদের এই সমস্যা হয়, তারা প্রায়ই গলায় জ্বলুনি, গলার ভেতরে ঝাল, টক বা লবণাক্ত তরলের অস্তিত্ব অনুভব করেন এবং ঢেকুর ওঠে। এসব লক্ষণ গ্যাসের সমস্যার কারণে হতে পারে। তবে যদি বুকের জ্বালা-পোড়া খুব বেশি হয়, এবং এ ধরনের অস্বস্তি ও ব্যথা বুক থেকে বাহু ও কাঁধের দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তবে তা হৃদযন্ত্রের কোনো সমস্যার কারণে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
গলা ও বুক জ্বালা-পোড়ার কারণসমূহ
গলা ও বুক জ্বালা-পোড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এসব কারণের মধ্যে প্রধান হচ্ছে গ্যাস্ট্রো ইজোফ্যাকাল রিফ্লেক্স ডিজিজ (Gastroesophageal Reflux Disease) বা গার্ড (GERD)। গার্ড হল একটি অবস্থা যেখানে পাকস্থলীর তরল পদার্থ খাদ্যনালী দিয়ে মুখ পর্যন্ত উঠে আসে। এই সমস্যার অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- খাদ্যাভ্যাস: ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়া, কালো গোল মরিচ, সিরকা যুক্ত খাবার, আচার, টমেটোর সস, কমলার রস, পেঁয়াজ, পিপারমেন্ট ইত্যাদি খাদ্য গ্রহণ।
- অ্যালকোহল ও ধূমপান: অ্যালকোহল সেবন বা মদ্য পান করা এবং ধূমপান করা।
- পানীয়: অতিরিক্ত চা, কফি ইত্যাদি পান করা।
- মানসিক চাপ: অতিরিক্ত মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা।
- গর্ভাবস্থা ও স্থুলতা: গর্ভাবস্থা এবং স্থুলতা।
- চাপ: শক্ত ও মোটা বেল্টের প্যান্ট পরা এবং পিত্ত থলিতে পাথর।
গলা ও বুক জ্বালা-পোড়ার লক্ষণসমূহ
গলা ও বুক জ্বালা-পোড়ার কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে। এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে বুঝতে হবে যে, আপনি গলা ও বুক জ্বালা-পোড়ার সমস্যায় ভুগছেন।
- মৃদু ব্যথা: পেটের উপরের দিকে মৃদু ব্যথ্যা অনুভূত হওয়া।
- বুকের জ্বালা: বুকের ব্যথ্যার সাথে জ্বালা জ্বালা ভাব থাকা।
- খালি পেটে জ্বালা: কারও কারও বুক জ্বালা খালি পেটে, আবার কারও খাবার গ্রহণের পরে হয়।
- ঢেকুর: বুক জ্বালা পোড়া হওয়ার মাঝে মাঝে ঢেকুর উঠতে পারে।
- পাকস্থলীর এসিড: পাকস্থলীর এসিড সম্প্রসারিত হয়ে খাদ্যনালী পর্যন্ত চলে আসলে বুকে ব্যথ্যা ও জ্বালা হতে পারে।
- বিশ্রাম: বিশ্রামের সময় বুক জ্বালাপোড়া ও ব্যথ্যার বৃদ্ধি হয়।
- মুখে তিতা স্বাদ: মুখে তিতা স্বাদ অনুভুত হতে পারে, বিশেষ করে সকালের দিকে বেশি ঘটে।
- স্বরভঙ্গ: স্বরভঙ্গ হয়ে যেতে পারে, যখন এসিড কণ্ঠস্বরকে ভারি করে তোলে।
- গলায় ক্ষত: গলায় ক্ষত হতে পারে, মনে হয় যেন গলা ছিলে গেছে।
- বমি: বুক জ্বালাপোড়া হওয়ার সাথে বমি বা বমিবমি ভাব হতে পারে।
- খাবার গিলতে কষ্ট: দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে খাদ্যনালী সংকুচিত হয়ে খাবার গিলতে কষ্ট হতে পারে।
গলা ও বুক জ্বালা-পোড়ার প্রতিরোধের উপায়
প্রতিদিনের জীবনে কিছু নিয়ম মেনে চললে গলা ও বুক জ্বালা-পোড়া প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ বিষয়ে কিছু টিপস দেওয়া হলো:
- খাবার পরিবর্তন: যেসব খাবার খেলে বা পানীয় পান করলে বুক জ্বলা-পোড়া করে, সেগুলো খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যেমন: টমেটো, কমলালেবু, লেবু, রসুন, পেঁয়াজ, চকলেট, কফি, চা এবং কোমল পানীয়।
- স্বাস্থ্যকর খাবার: ভাজা মাংসের পরিবর্তে সেঁকা অথবা ঝলসানো মাংস খাওয়া, কম তেল-চর্বিযুক্ত ও মসলাযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করা।
- খাবারের পরিমাণ: একসাথে বেশি পরিমাণে না খেয়ে কিছুক্ষণ পরপর অল্প অল্প করে খেতে হবে। এতে খাবার দ্রুত হজম হবে এবং পেটে অতিরিক্ত গ্যাস ও এসিড উৎপন্ন হবে না।
- খাওয়ার পরে শোয়া: খাওয়ার পরপর শুয়ে পড়া উচিত নয়। অন্তত ১ ঘন্টা অপেক্ষা করে তারপর ঘুমুতে যাওয়া উচিত।
- বিছানার উচ্চতা: ঘুমানোর সময় বিছানা থেকে মাথাকে ৪ থেকে ৬ ইঞ্চি উঁচুতে রেখে শয়ন করতে হবে।
- ধূমপান বর্জন: অবশ্যই ধূমপান বর্জন করতে হবে।
- ওজন কমানো: শরীরের বাড়তি ওজন থাকলে তা কমিয়ে ফেলতে হবে।
- ঢিলেঢালা পোশাক: মোটা বেল্টের প্যান্ট না পরে ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে।
- মানসিক চাপ কমানো: অবশ্যই মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে।
দ্রুত উপশমের জন্য করণীয়
গলা ও বুক জ্বালা-পোড়া সমস্যা থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে কিছু প্রাথমিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়:
- আলস্যতা এড়ানো: খাবারের পরে অবিলম্বে শোয়া উচিত নয়, বরং কিছুক্ষণ হাঁটা উচিত।
- এন্টাসিড: এন্টাসিড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে নিয়মিত না।
- চুইং গাম: খাবারের পর চুইং গাম চিবানো যেতে পারে, যা লালারস উৎপন্ন করে এবং এসিডকে নিচে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
- উচ্চস্থান: মাথাকে উঁচুতে রেখে ঘুমানো উচিত।
- অ্যালো ভেরা: অ্যালো ভেরা জুস পান করা যেতে পারে, যা জ্বালা কমাতে সাহায্য করে।
দীর্ঘস্থায়ী প্রতিকার
দীর্ঘস্থায়ীভাবে গলা ও বুক জ্বালা-পোড়া থেকে মুক্তি পেতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন প্রয়োজন। এর জন্য কিছু সুপারিশ:
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: প্রতিদিন স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং ঝাল, মসলাযুক্ত খাবার পরিহার করা।
- নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন কিছু সময় ব্যায়াম করা, যা হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে।
- পানির পরিমাণ বৃদ্ধি: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা, যা এসিডের প্রভাব কমাতে সাহায্য করে।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো, যাতে সমস্যা দ্রুত শনাক্ত করা যায়।
চিকিৎসকের পরামর্শ
যদি বুক জ্বালা-পোড়া দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং কোন ওষুধ বা ঘরোয়া পদ্ধতিতে উপশম না হয়, তবে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সঠিক কারণ নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
শেষকথা
বুক ও গলা জ্বালা-পোড়া সমস্যাটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অস্বস্তিকর অংশ। তবে সচেতনতা ও সঠিক জীবনযাপন পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ কমানো এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। পাশাপাশি কোনো সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সচেতনতা ও সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে বুক ও গলা জ্বালা-পোড়া সমস্যা মোকাবিলা করা যায়, যা আমাদের জীবনকে আরও সুস্থ ও সুন্দর করে তুলবে।